দিনে লেনদেন ১৭০০ কোটি

নতুন নতুন পণ্য চালু করার ফলে গ্রাহকেরা দিন দিন ডিজিটাল লেনদেনে অধিকতর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। এখন বিদেশের মতো দেশেও উবার, পাঠাও এবং সিএনজির ভাড়া মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরিশোধ করা যাচ্ছে। এমনকি রাজধানীর বাইরে অলিগলির দোকানেও আজকাল বিল দেওয়া যাচ্ছে বিকাশ, রকেট ও নগদের মতো সেবার মাধ্যমে। এতে ডিজিটাল লেনদেনে নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে।

মডেল: বন্নি
ছবি: কবির হোেসন

এখন ছোট-বড় কেনাকাটাতে হরহামেশা ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার হচ্ছে। বিক্রেতা ও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা গ্রহণে পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস) ব্যবহার করছে। বড়-ছোট ব্যবসার ক্ষেত্রেও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা নেওয়া হচ্ছে। আবার ইন্টারনেট ব্যাংকিং বা অ্যাপসের মাধ্যমেও ঘরে বসে টাকা লেনদেন করা যাচ্ছে।

এভাবে ডিজিটাল উপায়ে দেশে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। এর মধ্যে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা গ্রাহকের কেনাকাটার বিল বাবদ গ্রহণ করছে বিক্রেতা ও সেবাদাতারা। বাকি ৬০০ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে অ্যাপস বা ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে। ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিং এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের ফলে নগদ টাকার ব্যবহার দিন দিন কমে আসছে। এর মাধ্যমে ক্যাশলেস সোসাইটি তথা নগদবিহীন সমাজ হয়ে ওঠার পথে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ নগদ অর্থের লেনদেন কমে ডিজিটাল উপায়ের লেনদেন বাড়ছে। দেশে এসব সেবা চালুর এক দশক হয়ে গেলেও মূলত করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালেই ডিজিটাল লেনদেনে নতুন মাত্রা হয়েছে। যেমন, সরকারের দেওয়া বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার পুরোটাই এখন মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে বিতরণ করা হয়।

মোটাদাগে ডিজিটাল লেনদেনকে তিন ধাপে ভাগ করা যায়। প্রথমত, বিকাশ, নগদ ও রকেটের মতো সেবায় নগদ টাকা জমা দেওয়া ও উত্তোলন ছাড়া বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটা ও পরিষেবার বিল পরিশোধ হয় তা সবই ডিজিটাল লেনদেন। দ্বিতীয়ত, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস) এবং ই–কমার্স তথা অনলাইনভিত্তিক লেনদেন। তৃতীয়ত, ইন্টারনেট ব্যাংকিং বা অ্যাপসভিত্তিক সেবাও ডিজিটাল লেনদেন।

খাতসংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গেছে, দেশজুড়ে এখন ২ লাখ ৭০ হাজারটি ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান ও দোকান বিকাশের মাধ্যমে টাকা গ্রহণ করছে। আর নগদের এ রকম ৩১ হাজার মার্চেন্ট রয়েছে। রকেটেরও আছে কয়েক হাজার মার্চেন্ট। আর ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ৯৩ হাজার ৬৬২টি পিওএস বসিয়েছে। পাশাপাশি কিউআর কোডের মাধ্যমেও টাকা গ্রহণ করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে কার্ডের টাকা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কমবেশি ইন্টারনেট ব্যাংকিং সুবিধা চালু করেছে ব্যাংক।

এসব ডিজিটাল লেনদেন সেবার ফলে দেশের নাগরিক জীবনে নগদ টাকার ব্যবহার কমে আসছে। অন্য সব ডিজিটাল লেনদেন বেশি না করলেও মোবাইলে রিচার্জ করাটা এখন অনেকাংশেই মোবাইল ব্যাংকিংনির্ভর হয়ে উঠেছে। আগে নগদ টাকা নিয়ে মোবাইল অপারেটরগুলোর এজেন্টদের কাছে গিয়ে রিচার্জ করতে হতো। এ ছাড়া গ্যাস–বিদ্যুৎ ও পানির বিল পরিশোধ এবং কাউকে টাকা পাঠানোটা এখন হয়ে গেছে পুরো ডিজিটাল।

রাজধানীর একটি স্কুলের শিক্ষক রবিউল আলমের বেতন হয় ব্যাংক হিসাবে। এ ছাড়া তিনি বাসায় গিয়ে চারজন শিক্ষার্থীকে পড়ান। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা কেউ বিকাশে, আবার কেউবা নগদের মাধ্যমে তাঁর মাসিক টিউশন ফি পাঠিয়ে দেন। আর রবিউল আলম নিজেও বাসাভাড়া ও বিভিন্ন পরিষেবার বিল পরিশোধ করেন বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে। তিনি কেনাকাটা করেন ব্যাংকের কার্ড ব্যবহার করে। এর বাইরে হাতখরচ ও জরুরি প্রয়োজন মেটাতে তিনি প্রতি মাসের শুরুতে ব্যাংক থেকে কিছু টাকা তোলেন।

আলাপকালে রবিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘একসময় বেতনের পুরো টাকা চেকের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে তুলে আনতাম। সারা মাস তা খরচ করতাম। এখন তেমন টাকা তোলা লাগে না। মোবাইলে যে টাকা পাই, বাড়িভাড়া ও অন্যান্য খরচ মোবাইলেই মিটিয়ে দিই। হয়তো এমন দিন আসবে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে হিসাব থেকে বিভিন্ন খরচ কেটে নেওয়া হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত জানুয়ারিতে দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে মোট ৭৩ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকার লেনদেন হয়। এর মধ্যে নগদ টাকা জমা ও উত্তোলন হয় ৪২ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। বাকি ৩১ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা লেনদেন হয় অন্যকে পাঠানো, কেনাকাটা ও বিভিন্ন পরিষেবার বিল পরিশোধ, বেতন প্রদান এবং মোবাইল ফোন রিচার্জ বাবদ। এগুলোর সবই ডিজিটাল লেনদেন।

সেবাদাতারা বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন পণ্য চালু করার ফলে গ্রাহকেরা দিন দিন ডিজিটাল লেনদেনে অধিকতর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। এখন বিদেশের মতো দেশেও উবার, পাঠাও এবং সিএনজির ভাড়া মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরিশোধ করা যাচ্ছে। এমনকি রাজধানীর বাইরে অলিগলির দোকানেও আজকাল বিল দেওয়া যাচ্ছে বিকাশ, রকেট ও নগদের মতো সেবার মাধ্যমে। এতে ডিজিটাল লেনদেনে নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। এ জন্য সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চালু করেছে নিজস্ব অ্যাপস।

এসব নিয়ে কথা হয় বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল কাদীরের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছয় কোটি গ্রাহকের আস্থা নিয়ে বিকাশ আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমকেও এগিয়ে নিচ্ছে। বিকাশ সব সময়ই বিশ্বসেরা প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে গ্রাহকবান্ধব নতুন নতুন সেবা চালু করে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলেও যৌথ সেবার প্রচলন করে বিকাশ। একই সঙ্গে নিরাপদ ক্যাশলেস লেনদেনকে উদ্বুদ্ধ করছে। এর মাধ্যমে গ্রাহকদের আর্থিক লেনদেনে আরও স্বাচ্ছন্দ্য, স্বাধীনতা ও সক্ষমতা এনে দেওয়ার কাজ করছে বিকাশ।

গ্রাহকেরা নগদ টাকার ব্যবহার ছাড়াই কেনাকাটা ও সেবার বিল পরিশোধ, টিকিট ক্রয় বাবদ এসব লেনদেন করেছেন।

এখন ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ইন্টারনেট ব্যাংকিং সুবিধা দিচ্ছে। এ জন্য তারা নিজস্ব অ্যাপস চালু করেছে। এর মধ্যে সিটি ব্যাংকের সিটি টাচ, ইস্টার্ণ ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) স্কাই ব্যাংকিং, ঢাকা ব্যাংকের গো, ডাচ্‌–বাংলার নেক্সাস পে, ব্র্যাক ব্যাংকের আস্থা, ইসলামী ব্যাংকের সেলফিন ব্যাংক এশিয়ার স্মার্ট অ্যাপ, যমুনা ব্যাংকের জাস্ট পে এখন বেশ জনপ্রিয়। ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে এখন প্রতি মাসে ১৮ হাজার ৬২৩ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। গত জানুয়ারিতে গ্রাহকেরা ৪৫ লাখের বেশি লেনদেন করেছেন এই সেবার মাধ্যমে।

ব্যাংকাররা বলছেন, ডিজিটাল লেনদেনের অবকাঠামোর যত উন্নয়ন হবে নগদ টাকার লেনদেন তত কমে আসবে। এ জন্য দীর্ঘ মেয়াদে বড় বিনিয়োগের পাশাপাশি সরকারি নীতিসহায়তাও প্রয়োজন। পাশাপাশি গ্রাহকদেরও ডিজিটাল উপায়ের আর্থিক লেনদেন সম্পর্কে মৌলিক কিছু শিক্ষা দিতে হবে, যাতে তাঁরা স্বচ্ছন্দে সেবা নিতে পারেন।