ন্যাশনাল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সিকদার পরিবারে বিভক্তি

ন্যাশনাল ব্যাংক

চেয়ারম্যানের মৃত্যুর পর বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক পরিচালনা নিয়ে পরিচালকদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে ঋণ বিতরণ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পালন করা অতিরিক্ত এমডির কাজ করা নিয়ে এই বিভক্তি আরও প্রকট হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককেও দফায় দফায় নির্দেশনা দিতে হচ্ছে।

সিকদার পরিবারের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণেই চলছে ন্যাশনাল ব্যাংক। প্রয়াত চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের ছেলেরা চাইছেন ব্যাংকটি তাঁদের একক নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর মেয়ে সাংসদ পারভীন হক সিকদার ও অন্য পরিচালকেরা চাইছেন, ব্যাংকটির যে ভাবমূর্তি নষ্ট ও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে। এ জন্য তাঁর ভাইদের হাত থেকে ব্যাংকটি রক্ষা করতে চাইছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক এক দিন আগে ব্যাংকের অতিরিক্ত এমডি এ এস এম বুলবুলকে এমডির চলতি দায়িত্ব থেকে বিরত রাখতে নির্দেশনা দিয়েছিল। এরপরও ছেলেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার গতকাল দুপুরে এ এস এম বুলবুলের মেয়াদ এক মাস বাড়ানোর অনুমোদনে স্বাক্ষর করেন; যা কার্যকর ধরা হয়েছে ১ এপ্রিল থেকে। গতকাল দুপুরেই এই মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির সভা ডাকার নির্দেশ দিয়েছেন নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান পারভীন হক সিকদার।

আরও পড়ুন

ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১০ ফেব্রুয়ারি চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার মারা যাওয়ার পর ২৪ ফেব্রুয়ারি নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। এরপর কোনো পর্ষদ সভা না হলেও ঋণ বিতরণ ঠিকই অব্যাহত রয়েছে। চেয়ারম্যানের মৃত্যুর পর মূলত তাঁর ছেলেরা ব্যাংকটি পরিচালনা করছেন। ফলে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক ৪৫০ কোটি টাকার নতুন ঋণ বিতরণ করেছে। এ ছাড়া প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বিতরণ করেছে ১১৩ কোটি টাকা। ঋণের ওপর প্রথম প্রান্তিকে সুদ যুক্ত হয়েছে ৬৫০ কোটি টাকা। ফলে প্রথম তিন মাসে ব্যাংকটির ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ২১৩ কোটি টাকা। তবে তিন মাসে আমানত বেড়েছে মাত্র ৫২১ কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্যাংকটির ৪০টি শাখা লোকসানে রয়েছে।

গত ডিসেম্বরে ব্যাংকটির ঋণ ছিল ৪০ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা, গত মার্চে যা বেড়ে হয়েছে ৪২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। আর আমানত ৪৩ হাজার ৭৪ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। এর পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত সোমবার ব্যাংকটির ঋণ অনুমোদন ও বিতরণে একরকম নিষেধাজ্ঞা দেয়। পাশাপাশি ভারপ্রাপ্ত এমডি এ এস এম বুলবুলকে ব্যাংকের সব দায়িত্ব থেকে বিরত রেখে ব্যাংকের সব নথিতে তাঁর প্রবেশাধিকার বন্ধ করতে বলা হয়। কারণ, ৩১ মার্চ মেয়াদ শেষের পরও তিনি দায়িত্ব পালন করছিলেন।

আরও পড়ুন

গতকাল যা হলো

এমন পরিস্থিতিতে জয়নুল হক সিকদারের ছেলেদের নির্দেশে সকালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদারের বাসায় যান এ এস এম বুলবুলসহ ব্যাংকটির অন্য কর্মকর্তারা। তিনি বুলবুলের মেয়াদ এক মাস বাড়ানোর অনুমোদন দেন। সঙ্গে উল্লেখ করেন, ভালো সেবা ও বর্তমান এমডির দায়িত্ব বিবেচনা করে তাঁর মেয়াদ বাড়ানো হলো। তিনি এমডি পদে চলতি দায়িত্ব পালন করবেন। ব্যাংকের পরবর্তী সভায় এই অনুমোদন হবে বলে চেয়ারম্যান চিঠিতে উল্লেখ করেন। ন্যাশনাল ব্যাংক এই চিঠিসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিভিন্ন অভিযোগের জবাব পাঠায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুপুরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুলবুলের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি নাকচ করে দেয়।

এ এস এম বুলবুল গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকের চেয়ারম্যান মঙ্গলবার আমার মেয়াদ এক মাসের জন্য বাড়িয়েছেন। অতিরিক্ত এমডির পাশাপাশি আমি এমডি পদে চলতি দায়িত্বও পালন করব। পরবর্তী পর্ষদ সভায় এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। ১০-১২ দিনের মধ্যে পর্ষদ সভা হবে।’ তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে পরে ফোন করে তাঁকে আর পাওয়া যায়নি।

ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদারের কাছে পাঠানো চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, মঙ্গলবার এ এস এম বুলবুলকে এমডির (চলতি দায়িত্ব) দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োজিত করা হয়েছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনের ৪.১ (চ) অনুচ্ছেদে বর্ণিত নির্দেশনার পরিপন্থী। এ অবস্থায় বুলবুলকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যাংকের এমডির (চলতি দায়িত্বে) দায়িত্ব পালন থেকে অবিলম্বে বিরত রাখার জন্য অনুরোধ করা হলো।

আরও পড়ুন

পরিচালক নিয়োগসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনের ৪.১ (চ) অনুচ্ছেদে রয়েছে, ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি সুদৃঢ়করণ এবং আমানতকারীদের আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সৎ, দক্ষ, অভিজ্ঞ ও উপযুক্ত এমডি নিয়োগ করা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অন্যতম দায়িত্ব। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনক্রমে পরিচালনা পর্ষদ একজন উপযুক্ত এমডি নিয়োগ করবে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁর মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া যথাযথ হয়নি। এ জন্য তাঁকে এমডি পদে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এমডির দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।’

ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার, পরিচালক তাঁর মেয়ে পারভীন হক সিকদার, ছেলে রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদার। এ ছাড়া সিকদার গ্রুপের কর্মকর্তা নাইমুজ্জামান ভুইয়া ও বদিউল আলম পরিচালক হিসেবে রয়েছেন।

এরপরেই পারভীন হক সিকদার ব্যাংকটিতে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ সৈয়দ আবদুল বারিকে চিঠি দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে নির্বাহী কমিটির সভা ডাকার নির্দেশ দিয়েছেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠি ও প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ব্যাংকটির বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে অনলাইনে নির্বাহী কমিটির সভা ডাকার নির্দেশ দিচ্ছি। সভা আয়োজনে কোনোভাবে ব্যর্থ হওয়া যাবে না। জরুরি ভিত্তিতে সভা ডাকার বিষয়টি নির্বাহী কমিটির সদস্যদের জানাতে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে যেসব অভিযোগ এসেছে এবং জানুয়ারির পর অনুমোদন ছাড়া যেসব ঋণ বিতরণ হয়েছে, তার ব্যাখ্যা দিতে ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন পারভীন হক সিকদার। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, আমার জানামতে এ এস এম বুলবুলের মেয়াদ ৩১ মার্চ শেষ হয়েছে। তাই তিনি শাহ সৈয়দ আবদুল বারিকে দ্রুত সভা আহ্বানের নির্দেশ দেন।

ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার, পরিচালক তাঁর মেয়ে পারভীন হক সিকদার, ছেলে রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদার। এ ছাড়া সিকদার গ্রুপের কর্মকর্তা নাইমুজ্জামান ভুইয়া ও বদিউল আলম পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। এর বাইরে পরিচালক রয়েছেন কেডিএস গ্রুপের খলিলুর রহমান, হোসাফ গ্রুপের মোয়াজ্জেম হোসেন ও মাবরুর হোসেন এবং জাকারিয়া তাহের। এর মধ্যে সিকদার পরিবারের বাইরে পর্ষদের অন্য সদস্যরা নামেমাত্র।

এ নিয়ে সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরো ব্যাংক খাতে অস্থিরতা চলছে। ন্যাশনাল ব্যাংক তার একটি অংশমাত্র। একটি পরিবারের হাতে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকলে কী হয়, তার প্রমাণ এই ব্যাংকটি। তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থারও তোয়াক্কা করতে চায় না। মূলত যারা রাজনৈতিক সমর্থন পায়, তারাই এমন আচরণ করে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। এতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বাধা দেওয়া যাবে না। কারণ, কয়েকটি ব্যাংকের কারণে সরকারের অনেক ভালো কাজও হারিয়ে যাচ্ছে।’