পিপলস লিজিংয়ের পুনর্গঠন কত দূর

চলছে বিশেষ নিরীক্ষা। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের পরই পুনর্গঠন হতে পারে। আমানতকারীরা টাকা ফেরত পেতে ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে।

অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারেনি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। এর প্রভাব পড়ে পুরো আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে, যা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

এই কারণে পিপলস লিজিংকে নতুন করে পুনর্গঠন করতে চাইছে সরকার। তবে ঠিক কত দিনে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। এদিকে পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ চিহ্নিত করতে কাজ শুরু হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে অবসায়নের প্রক্রিয়া। আর আমানতকারীরা এখনো ঘুরছেন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দ্বারে দ্বারে। ফলে যাঁরা পিপলস লিজিংয়ে টাকা জমা রেখেছিলেন, তাঁরা পড়েছেন বিপদে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, পিপলস লিজিংয়ের সাবেক পরিচালক আলমগীর শামসুল আলামিন এই পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন আর্থিক খাতের সফটওয়্যার সরবরাহকারী ফ্লোরা টেলিকমের কর্ণধার মোস্তফা রফিকুল ইসলাম ও শেয়ারবাজারের সম্পদ ব্যবস্থাপনাকারী প্রতিষ্ঠান এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলাম। ইতিমধ্যে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হাওলাদার ইউনুস অ্যান্ড কোম্পানিকে প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ঠিক কত টাকা আদায় হতে পারে, তা জানাবে। যারা ঋণ নিয়েছে, তাদের কাছ থেকে কত টাকা ফেরত আসতে পারে, তা-ও তুলে ধরবে। এর মাধ্যমে পিপলস লিজিংয়ের পুরো ক্ষয়ক্ষতির চিত্র বের করে আদালতে উপস্থাপন করা হবে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পুনর্গঠন প্রস্তাব তুলে ধরবেন এই উদ্যোক্তারা। এতে সরকারসহ বিভিন্ন পক্ষ রাজি হলে পিপলস লিজিং পুনর্গঠিত হবে।

আরও পড়ুন
আমরা পিপলস লিজিংকে নতুন করে পুনর্গঠন করতে চাই। এ জন্য ক্ষয়ক্ষতি কত হয়েছে, তা জানতে নিরীক্ষা চলছে। এরপর আদালতের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হবে।
আলমগীর শামসুল আলামিন এমডি, শামসুল আলামিন গ্রুপ

আবাসন খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন রিহ্যাবের সভাপতি ও শামসুল আলামিন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলমগীর শামসুল আলামিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পিপলস লিজিংকে নতুন করে পুনর্গঠন করতে চাই। এ জন্য ক্ষয়ক্ষতি কত হয়েছে, তা জানতে নিরীক্ষা চলছে। এরপর আদালতের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে আমরা নতুন করে প্রতিষ্ঠানটিকে ঢেলে সাজাতে চাই। আমাদের সঙ্গে দেশের কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে, যারা এর পর্ষদে যুক্ত হবে। যদি সব পক্ষ রাজি হয়, তাহলেই পুনর্গঠিত হবে পিপলস লিজিং। দ্রুত সময়ে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য আমরা চেষ্টা করছি।’

বর্তমানে পিপলস লিজিংয়ের কোনো পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কমিটি নেই। আদালতের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান অবসায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অবসায়ক চেষ্টা করছেন, আদালতের মাধ্যমে ঋণের টাকা ফেরত আনার। তবে এখন পর্যন্ত মাত্র ৪০ কোটি আদায় হয়েছে। যদিও আমানতকারীরা এখনই কোনো টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। ফলে মানবেতর জীবন যাপন করছেন অনেক আমানতকারী।

আরও পড়ুন

পিপলস লিজিংয়ের ক্ষুদ্র আমানতকারীদের সংগঠনের সমন্বয়কারী সামিয়া বিনতে মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ও আমার স্বামী বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করতাম। সেখান থেকে পাওয়া টাকা ও গয়না বিক্রি করে এক কোটি টাকা পিপলস লিজিংয়ে রেখেছিলাম। ছয় মাস পর একটা জমি কেনার জন্য টাকাটা জমিয়েছিলাম। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর অর্থাভাবে আমার চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার ছেলেকে স্কুলে দিতে পারছি না। মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে।’

সামিয়া বিনতে মাহবুব আরও বলেন, ‘পিপলস লিজিং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান ছিল। এখানে টাকা রাখা তো কোনো অপরাধ হতে পারে না। মানুষ কী দেখে টাকা রাখবে, তার কোনো সূচকও তো নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যাঁরা এ জন্য দোষী, তাঁদেরও কোনো শাস্তি হলো না। জমানো টাকা ফেরত না পেয়ে অনেকে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। অনেকেই খাবারের অভাবে ভুগছেন।’

কার্যক্রম শুরুর ২২ বছরের মধ্যে এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নে পাঠাতে হয় সরকারকে। এ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দেখভালের দায়িত্বও ছিল এ সংস্থার। তদারকি দুর্বলতা ও পরিচালকদের অনিয়মের কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখন দেউলিয়া। এমন অবস্থা আরও কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরও।

১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিপলস লিজিংকে অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ২০১৯ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পিপলস লিজিংকে অবসায়নের পক্ষে সম্মতি দেয় সরকার। এরপর আদালতের আদেশে নিযুক্ত হন অবসায়ক।