বাচ্চুর দেওয়া ঋণে বিশেষ সুবিধা নয়

শেখ আবদুল হাই বাচ্চু

বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুর মেয়াদে দেওয়া ঋণ বিশেষ সুবিধার আওতায় পুনঃ তফসিল করেনি ব্যাংকটি। এসব ঋণকে কোনো সুবিধা দিলে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের ওপর দায় আসতে পারে, এ জন্যই ব্যাংকটি এ সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে ব্যাংকটি নতুন করেও কোনো ঋণ দিচ্ছে না। ঘুরে দাঁড়াতেও নেই কোনো পরিকল্পনা। ফলে সীমিত হয়ে গেছে ব্যাংকটির কার্যক্রম।
গত মার্চের শেষে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণ ছিল ১৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৭ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঋণের ৫২ শতাংশ খেলাপি। এর ফলে ২০১৯ সালেও ব্যাংকটি ৩২৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে। ২০১৮ সালে লোকসান করেছিল ৩৫৩ কোটি টাকা। ২০১০ সালে শেখ আবদুল হাই দায়িত্ব নেওয়ার আগে ব্যাংকটি প্রতিবছর গড়ে ৫০ কোটি টাকা মুনাফা করে আসছিল।
বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদের মেয়াদ গত ২৭ জুলাই শেষ হয়েছে। নতুন করে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। শেখ আবদুল হাইয়ের পর তাঁকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয় সরকার।

২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত শেখ আবদুল হাই বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বের করা হয়। এর বেশির ভাগ টাকা ব্যাংকটি আদায় করতে পারছে না। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বেশ কিছু ঋণের বিষয়ে অনুসন্ধান শেষে মামলা করেছে। তবে দুদক শেখ আবদুল হাইয়ের কোনো দায় খুঁজে পায়নি। অথচ সরকারি একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন তাঁকেই অভিযুক্ত করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সাবেক চেয়ারম্যান ও এমডি মিলে ব্যাংকটিকে শেষ করে দিয়েছে। তাঁদের মেয়াদে দেওয়া ৮০ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়েছে। সরকার তাঁদের ধরতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ব্যাংকটিকে ঠিক করতে কোনো পরিকল্পনা করেনি। যাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, তাঁরা সময় পার করছে। কেউ ব্যাংকটির ভেতরের সমস্যা নিয়ে কাজ করছে না। এভাবে একটি ব্যাংক চলতে দেওয়া উচিত নয়। এতে অন্যান্য ব্যাংক সমস্যায় পড়ে।

এদিকে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে সরকার বিশেষ সুযোগ দিলে শেখ আবদুল হাইয়ের সময়ে ঋণ নেওয়া অনেকেই ব্যাংকটির সঙ্গে যোগাযোগ করে পুনঃ তফসিল করতে চাইছেন। তবে সেসব ঋণ প্রদানে অনিয়ম ও জালিয়াতি হয়েছে বলে ব্যাংকটি তাতে কোনো সাড়া দিচ্ছে না।
বেসিক ব্যাংক এ নিয়ে গত জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানিয়েছে, ২০১০-১৪ সালে জামানত হিসেবে ভুয়া সম্পত্তি, জামানতের ত্রুটিপূর্ণ মালিকানা, হালনাগাদ ঋণ তথ্য ব্যুরো (সিআইবি) রিপোর্ট ও ক্রেডিট রেটিং রিপোর্ট গ্রহণ না করা, ছলচাতুরীর মাধ্যমে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তায় অর্থ গ্রহণ, নিয়ম লঙ্ঘন করে দেওয়া ঋণ বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিশেষ সুবিধার আওতায় পুনঃ তফসিল করতে রাজি নয়। পর্ষদ মনে করে, ছলচাতুরীর মাধ্যমে যাঁরা ঋণ নিয়েছেন, তাঁরা প্রকৃত ব্যবসায়ী হতে পারেন না।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ১২ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ঋণঝুঁকি বিবেচনায় পুনঃ তফসিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের বিবেচ্য। কেননা, আইনি বাধা না থাকলেও আলোচ্য ঋণ পুনঃ তফসিল করার পর ভবিষ্যতে কোনো অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে তার দায় বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকেই নিতে হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যাংকের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, নিরীক্ষা ও এর পরিপালনের জন্য পরিচালনা পর্ষদ দায়বদ্ধ থাকবে। যাঁরা অনিয়মের আশ্রয়ে ঋণ নিয়েছেন, তাঁরা প্রকৃত ব্যবসায়ী নন, এ বিবেচনায় ঋণ পুনঃ তফসিল না করা পর্ষদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনারই অংশ।

বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আলম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যেসব ঋণে অনিয়ম-জালিয়াতি হয়েছে, তা পুনঃ তফসিল করা হয়নি। কারণ, এসব ঋণ নিয়ে দুদকের মামলা রয়েছে। আমরা গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছি।’
জানা গেছে, ব্যাংকটির শীর্ষ ১৫ খেলাপি গ্রাহকের কাছেই পাওনা প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকটির শীর্ষ খেলাপিরা হলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এমারেল্ড অয়েল, নিউ ঢাকা সিটি ডেভেলপমেন্ট, ফিয়াজ গ্রুপ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, মিমকো গ্রুপ, ভাসাভি, তাহমিনা ও ওয়াটার হেভেন কোম্পানি, ওয়েল টেক্স, আরআই এন্টারপ্রাইজ, রাইজিং গ্রুপ, ডেলটা সিস্টেম, ম্যাপ অ্যান্ড মুলার গ্রুপ, ক্রিস্টাল স্টিল অ্যান্ড শিপ ব্রেকিং ও রিজেন্ট ওয়েভিং। এর মধ্যে ফিয়াজ গ্রুপের ওয়াহিদুর রহমান, বেলায়েত নেভিগেশন ও রিলায়েন্স শিপিং লাইনসের গাজী বেলায়েত হোসেন দেশছাড়া।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন