বাড়ল ডলারের দাম, খতিয়ে দেখা হচ্ছে ১২ ব্যাংকের মজুত

বাংলাদেশ ব্যাংক
ছবি: সংগৃহীত

ডলারের দাম আরেক দফা বাড়ল। তবে এবার একবারেই বাড়ানো হয়েছে ১ টাকা ১০ পয়সা। ফলে এখন ডলার কিনতে হবে ৮৯ টাকায়। একপ্রকার সমঝোতা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমানো হলো। তবে ১ টাকা ১০ পয়সা বাড়ানোর ফলে ডলারের সংকট কেটে যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে ব্যাংকারদের মধ্যেই। এর আগের দর ছিল ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা।

এদিকে বেসরকারি খাতের ১২টি ব্যাংকের ডলার কেনাবেচা ও মজুতের তথ্যও খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অভিযোগ এসেছে যে এসব ব্যাংক বেশি দামে প্রবাসী আয় এনে বাজারে ডলারের দাম বাড়িয়েছে, আবার কৌশলে সীমার বেশি ডলার মজুত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ভুল তথ্য দিয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক শিগগিরই জরিমানার মুখে পড়বে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

ডলারের সংকট কাটাতে গত বৃহস্পতিবার ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেডা) নেতাদের সঙ্গে এক সভা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরই ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ডলারের দাম বাড়ানো হলো। এর আগে কোনো আলোচনা ছাড়াই টাকার মান কমিয়ে এনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে টাকার আরেক দফা অবমূল্যায়নের ফলে আমদানির খরচ আরও বাড়বে। অন্যদিকে রপ্তানিকারকেরা লাভবান হবেন। সাধারণত রপ্তানিকারকদের সুবিধা দিতেই স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে হয়। তবে এখন বাংলাদেশকে এই পথে যেতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। আমদানি পণ্যের দাম ও জাহাজভাড়া বেড়ে যাওয়ায় ইতিমধ্যে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে সেই খরচ মেটানো যাচ্ছে না। এতে ডলারের সংকট তৈরি হচ্ছে। সংকট সামলাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতেই বেড়ে গেছে ডলারের দাম। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করে ডলারের দাম ধরে রাখার উদ্যোগ নিয়েছে। গত সপ্তাহে প্রবাসী আয়ে ৯৭ টাকা পর্যন্ত দর দিয়েছে কিছু ব্যাংক। আমদানিকারকদের এর চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে হয়েছে। ফলে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। আর খোলাবাজারে ৯৬-৯৭ টাকা দরে ডলার বিক্রি হচ্ছে।

জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতি ডলারের এই আন্তব্যাংক দর আজ সোমবার থেকে কার্যকর হবে।

কোন লেনদেনে ডলারের কত দর

বৃহস্পতিবারের সভায় প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য কত হবে, তা নির্ধারণের জন্য ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন প্রস্তাব দিতে বলা হয়। গতকাল রোববার দুপুরে বাফেডার চেয়ারম্যান আতাউর রহমান প্রধান ও এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন ডলারের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে এক চিঠি দেন। এতে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিত ভিত্তিতে বাজারে ডলারের জোগান দিয়ে ও ডলারের দাম পুনর্বিবেচনা করলে বর্তমান পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে।

বাফেডা ও এবিবি আন্তব্যাংক লেনদেন ডলারের দাম ৮৯ টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণ করতে বলে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এত দাম বাড়ানোর সম্মতি দেয়নি। আগে যা ছিল ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা। গতকাল সন্ধ্যায় গভর্নর প্রতি ডলারের দাম ৮৯ টাকা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত দেন।

গত সপ্তাহে ৯৭ টাকা দরেও প্রবাসী আয় এনেছে কিছু ব্যাংক। এখন প্রবাসী আয়ে ৮৯ টাকা ৭৫ পয়সা দাম দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল সংগঠন দুটি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম ৮৯ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়ায় এর চেয়ে কম দামে আনতে হবে প্রবাসী আয়। না হলে লোকসান গুনতে হবে ব্যাংকগুলোকে।

আমদানিকারকদের কাছে বিক্রিতে ডলারের দাম ৮৯ টাকা ৭৫ পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাব ছিল, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা সায় দেয়। আর রপ্তানি বিল নগদায়নে ৮৮ টাকা ৯৫ পয়সার প্রস্তাবের বিপরীতে ৮৮ টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণের সায় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তবে এসব দর নির্ধারণের বিষয়ে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী ডলারের দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

রপ্তানি বিল নগদায়ন

ডলারের সংকটে অনেক রপ্তানিকারক নিজ ব্যাংকে রপ্তানি বিল নগদায়ন না করে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে দর-কষাকষি করেছে। এতে বেড়ে গেছে ডলারের দাম। এ জন্য এবিবি ও বাফেডা চিঠি দিয়ে গভর্নরকে নিশ্চয়তা দিয়েছে, সব রপ্তানি বিল নিজ ব্যাংকে নগদায়ন হবে। অন্য ব্যাংকে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। পাশাপাশি রপ্তানি বিলের মধ্যে দায় বাদে বাকি অংশ দিনে দিনেই টাকায় গ্রাহককে দেওয়া হবে। এতে গ্রাহকেরাও আর ডলারের দাম নিয়ে ছোটাছুটি করতে পারবে না।

ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শ মেনে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, সবাই তা মেনে চললে সংকট কেটে যেতে পারে। ভারতেও এভাবে দর বেঁধে দেওয়া হয়। তবে খোলাবাজারের সঙ্গে পার্থক্য বেশি হয়ে গেলে বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় কেমন আসবে, এটা প্রশ্ন রয়েছে। প্রয়োজনে আমরা দাম বাড়াতে আবারও প্রস্তাব দেব। তবে এক দামে সব ব্যাংক শৃঙ্খলার মধ্যে থাকলে সংকট থাকবে না।’