বাড়ির কাছেই ব্যাংক সেবা

বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বিশ্বের কয়েকটি দেশে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু হয়। আর বাংলাদেশে সেবাটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ২০১৪ সালে। ওই বছরের ১৭ জানুয়ারি ব্যাংক এশিয়া প্রথম এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা দেওয়া শুরু করে। দেশে এখন ২৯টি ব্যাংক এই সেবা দিচ্ছে। করোনার মধ্যেও বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে এই সেবার। এবারের এজেন্ট ব্যাংকিং নিয়ে এবারের বিশেষ আয়োজন।

একসময় ব্যাংকের সেবা পেতে হলে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষকে অন্যান্য কাজ ফেলে কয়েক কিলোমিটার দূরের উপজেলা সদরে কিংবা বড় কোনো হাটবাজারে যেতে হতো তা টাকা জমা দেওয়া বা ওঠানো, বিল পরিশোধ কিংবা প্রবাসী আয় সংগ্রহ যা–ই হোক। এ জন্য আগে থেকেই তাঁদের পরিকল্পনাও করতে হতো। তবে এখন সময় বদলে গেছে। বাড়ির পাশেই চলে এসেছে ব্যাংকিং সেবা। অর্থাৎ হাতের নাগালেই মিলছে ব্যাংকের বিভিন্ন সেবা। আর এসব সেবা দিচ্ছেন পেশাদার কোনো ব্যাংকার নন, বাড়ির আশপাশেরই পরিচিত কেউ। তাঁরা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এ সেবা দেন।

এভাবে দেশে আট বছরের মধ্যে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে দেশের বেশির ভাগ উপজেলা তো বটেই, অধিকাংশ হাটবাজার এবং এমনকি গ্রামেও পৌঁছে গেছে এ সেবা। এর মানে হলো ব্যাংকিং সেবা বাড়ির পাশেই পৌঁছে গেছে।

আর শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সুপরিসর ও ছিমছাম শাখা থেকে ব্যাংকিং সেবা চলে এসেছে সাদামাটা ছোট ঘরে। শাখার মতো প্রটোকল কিংবা স্যুট-টাই পরা পরিপাটি কর্মীও নেই। এরপরও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা মিলছে। এতে একদিকে যেমন প্রত্যন্ত অঞ্চলের নাগরিকেরা সুবিধা পাচ্ছেন, অন্যদিকে ব্যাংকগুলোও কম সুদে আমানত সংগ্রহ করতে পারছে। কম খরচে ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন সেবা পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এই সেবাদাতারা ব্যাংকের নিয়োগ পাওয়া কর্মী নন, এজেন্ট। তাঁরা ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছেন। এ জন্য তাঁরা মাশুলের ওপর কমিশন পান। এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু হওয়ায় অনেকেরই নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকসেবা যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি গ্রাহক ও এজেন্ট ব্যাংক তিন পক্ষই লাভবান হচ্ছে।

সর্বস্তরের মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি দেশে এজেন্ট ব্যাংকিং নামে নতুন ধাঁচের এ সেবা চালু হয়েছিল। গত ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নতুন এ ব্যাংকিং কার্যক্রমের আওতায় হিসাব খুলেছেন মোট ৮২ লাখ গ্রাহক। আর সদ্য বিদায়ী ২০২১ সালের একই মাসে (সেপ্টেম্বর) গ্রাহকসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ। অর্থাৎ মাত্র এক বছরে যুক্ত হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ নতুন গ্রাহক। যাত্রা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত আট বছরে দেশব্যাপী পাড়া-মহল্লা ও হাটবাজারে সাড়ে ১৩ হাজার এজেন্ট ও ১৮ হাজার আউটলেট এ সেবা দিচ্ছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর দিকে (২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিল) ব্যাংকের শাখা বন্ধ থাকার সময় সব এজেন্ট খোলা ছিল। এতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ওপর মানুষের আস্থা বেড়েছে। বদৌলতে করোনাকালে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বেরে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা দিত ২৪টি ব্যাংক। এখন ২৯টি ব্যাংক এ সেবা দিচ্ছে।

ব্যাংকগুলো এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারেও সেবা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে এজেন্টরা আমানত গ্রহণ ও ঋণ বিতরণ, বিদেশ থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় সুবিধাভোগীদের প্রদান করছে। এর পাশাপাশি তারা স্কুল ব্যাংকিং সেবা যেমন দিচ্ছে, তেমনি সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতাও বিতরণ করছে। সব মিলিয়ে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু হওয়ার ফলে সারা দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হয়ে উঠছে। এ ছাড়া ১৮ হাজার এজেন্ট আউটলেটে প্রায় ৫০ হাজার তরুণের কর্মসংস্থান তো আছেই।

খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা বাজারে ২০২০ সালের শুরু থেকে ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন মোহাম্মদ রেজাউল করিম। পাশাপাশি চট্টগ্রামেও তাঁর এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবসা রয়েছে। চাকরি ছেড়ে এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবসায়ে আসা রেজাউল করিমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে জানান, তাঁর মাধ্যমে খাগড়াছড়ির প্রায় ১ হাজার ৩০০ জন ব্যাংক এশিয়ার নতুন গ্রাহক হয়েছেন। আমানত জমা হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা। তাঁর মাধ্যমে ছোট অঙ্কের ঋণও যাচ্ছে।

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেবা ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নারীদের ব্যাংকের গ্রাহক হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। ফলে দেশে মোট ব্যাংক হিসাবের মধ্যে এখন প্রায় ২৫ শতাংশ নারী গ্রাহকদের। আবার এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মোট গ্রাহকের মধ্যে ৬০ লাখ ৪২ হাজার ৯৪৬ জন বা ৪৭ শতাংশই হলেন নারী। অবশ্য এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর ভাতা বিতরণের সুবাদেই নারী গ্রাহক বেশি বেড়েছে। কারণ, সরকারি ভাতাভোগীদের বেশির ভাগই নারী।

জানতে চাইলে ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরফান আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা করার ক্ষেত্রে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা বড় ভূমিকা রাখছে। এজেন্টরা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। একদিন সব আর্থিক সেবা দিতে এজেন্টরাই হবে প্রধান মাধ্যম।’