বিকাশে আয় আসছে নিমেষে
এক্সচেঞ্জ হাউস বা ব্যাংকের পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে মোবাইল অ্যাপ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। মুহূর্তেই টাকা পেয়ে যাচ্ছেন দেশে থাকা স্বজনেরাও।
ঢাকার গেন্ডারিয়ার মাসুদ মৃধা ২০১২ সাল থেকে সিঙ্গাপুরে থাকেন। পরিবারের কাছে নিয়মিত টাকা পাঠান তিনি। আগে কারও মাধ্যমে বা ব্যাংকে টাকা পাঠাতেন। দেড় বছর ধরে বিকাশের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। এতে তাঁর পরিবারের টাকা পাওয়া সহজ হয়েছে।
মাসুদ মৃধা আগে টাকা পাঠালে বাড়িতে ফোন করতেন। এরপর পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিত হয়ে ব্যাংকে যেতেন। অনেক সময় অন্য কারও মাধ্যমে টাকা পাঠাতেন, তখন টাকা আনতে তাঁর কাছে যেতে হতো। এতে সময় অনেক বেশি লেগে যেত, হয়রানিও কম হতো না। এখন তিনি বিকাশে টাকা পাঠান, আর তা হিসাবে চলে আসে।
মাসুদ মৃধার মতো প্রবাসী বাংলাদেশিরা এখন সহজেই দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। এক্সচেঞ্জ হাউস বা ব্যাংকের পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে মোবাইল অ্যাপ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে টাকা পাঠাচ্ছেন তাঁরা। আর স্বজনেরা সহজেই টাকা পেয়ে যাচ্ছেন মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) বিকাশের হিসাবে। ফলে জরুরি প্রয়োজনে দেশে টাকা পাঠাতে প্রবাসীদের আর অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। মুহূর্তেই টাকা পেয়ে যাচ্ছেন দেশে থাকা স্বজনেরাও।
করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যে এই সুবিধা প্রবাসী ও তাঁদের স্বজনদের স্বস্তি দিয়েছে। কারণ, টাকা পাঠানো ও গ্রহণের জন্য ব্যাংক, এক্সচেঞ্জ হাউস বা অন্য কোথাও যেতে হচ্ছে না। আবার বিকাশ হিসাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যোগ হচ্ছে সরকারঘোষিত ২ শতাংশ আর্থিক প্রণোদনা। সরকারি প্রণোদনার পাশাপাশি বিভিন্ন সময় প্রবাসী আয়ে অতিরিক্ত ১ শতাংশ প্রণোদনা দিয়েছে বিকাশ।
এই সুবিধার ফলে বিকাশের মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসা ধীরে ধীরে বাড়ছে। আর সব মাধ্যম মিলিয়ে সদ্য বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৬ শতাংশ বেশি। বিকাশের হিসাবে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসছে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, কাতার, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও যুক্তরাজ্য থেকে।
জানা গেছে, বিশ্বের ৯৩টি দেশ থেকে ৫০টির বেশি অর্থ স্থানান্তর প্রতিষ্ঠান থেকে বিকাশ হিসাবে টাকা পাঠানো যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে অনেক দেশে থাকা প্রবাসীরা নিজেই সেই দেশে ব্যবহৃত ওয়ালেট ও অনলাইন হিসাব থেকে দেশে টাকা পাঠাতে পারছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার হানপাস ও জিমানির মতো ওয়ালেটভিত্তিক সেবার মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীরা মোবাইল ওয়ালেট থেকে সহজেই দেশে স্বজনদের বিকাশ হিসাবে টাকা পাঠাতে পারছেন।
ওয়ার্ল্ড রেমিট, ট্রান্সফার ওয়াইজ, রিয়া, গালফ এক্সচেঞ্জ, বাহরাইন ফিন্যান্সিং কোম্পানি (বিএফসি), ব্র্যাক সাজান, সিবিএল মানি ট্রান্সফার, অগ্রণী এক্সচেঞ্জ, এনবিএল এক্সচেঞ্জের মতো অর্থ স্থানান্তর প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সহজে বিকাশ হিসাবে টাকা পাঠানো যায়। দেশের নয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এই অর্থ লেনদেন বৈদেশিক মুদ্রায় নিষ্পত্তি হচ্ছে। এই টাকা বিদেশ থেকে দেশে স্থানান্তর হচ্ছে কয়েক মুহূর্তে। এতে প্রবাসী বা তাঁর স্বজনদের ব্যাংক হিসাব থাকার প্রয়োজনও পড়ছে না।
বিকাশের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আলী আহমেদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থ স্থানান্তর প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কত সহজে ও দ্রুততম সময়ে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো যায়, সে লক্ষ্যে বিকাশ নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন প্রবাসীরা কম খরচে, দ্রুত ও সহজেই প্রিয়জনের কাছে টাকা পাঠাতে পারছেন, অন্যদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতেও এই সেবা সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।’
প্রবাসীরা বলছেন, সহজেই আয় পাঠানোর সুযোগ চালু হওয়ায় কর্মসময়ের অপচয় কমে গেছে। অনলাইন বা অ্যাপ থেকে আয় পাঠানো যাচ্ছে। যিনি প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন, তিনি নিজের সময়মতো পাঠাচ্ছেন। আর যাঁরা প্রবাসী আয় গ্রহণ করছেন, তাঁদেরও ব্যাংকিং সময়ে টাকা তোলার বাধ্যবাধকতা থাকছে না। যখন প্রয়োজন, ঠিক তখনই বিকাশ থেকে টাকা খরচ করতে পারছেন।
মালয়েশিয়াপ্রবাসী আকতারুল ইসলাম বলেন, ‘বিকাশে টাকা পাঠাতে আলাদা নিবন্ধন লাগে না। যাঁকে পাঠাব, তাঁর বিকাশ নম্বর দিলেই চলে। মুহূর্তেই টাকা দেশে চলে যায়। শুধু দেশে নয়, একেবারে স্ত্রীর বিকাশ নম্বরে চলে যায়। এখন আর তাঁকে টাকার জন্য কোথাও যেতে হয় না। সময় মেনে টাকা পাঠাতে হয় না, সেও যখন-তখন টাকা খরচ করতে পারে। এতে টাকা পাঠানো ও গ্রহণের চিন্তা থেকে দুজনেরই মুক্তি মিলেছে।’
বিকাশে আসা প্রবাসী আয়ের অর্থ দেশের ২ লাখ ৭০ হাজার এজেন্টের কাছ থেকে তোলা যাচ্ছে। আবার ব্র্যাক, বেসিক, ফার্স্ট সিকিউরিটি, আইএফআইসি, যমুনা, মিডল্যান্ড, শাহজালাল ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সব এটিএম থেকেও বিকাশের টাকা তোলা যাচ্ছে।
বিকাশের মাধ্যমে দেশে প্রবাসী আয় বিতরণ শুরু হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। ২০১৮ সালে বিকাশের মাধ্যমে আসে ১৩৪ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭১ কোটি টাকার বেশি। আর ২০২০ সালে আসে ১ হাজার ১৫১ কোটি টাকার বেশি।
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ অগ্রণী, প্রাইম ও সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আগে প্রবাসী আয় পেতে সাত দিন পর্যন্ত সময় লেগে যেত, এখন সঙ্গে সঙ্গে তা পাওয়া যাচ্ছে। টাকা নিজের হিসাবে চলে আসছে। এতে ঝুঁকিও নেই। এতে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হচ্ছে। তবে এসব অর্থে যদি স্বজনেরা ছোট ছোট ব্যবসা গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়ের অবদান বাড়বে।