পৌর উন্নয়ন তহবিল
বিশ্বব্যাংকের ঋণ বন্ধ, সংকটে মেয়ররা
বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল থাকার কারণে দুই বছর ধরে কোনো সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাকে ঋণ দিতে পারছে না বিএমডিএফ।
পটুয়াখালী পৌরসভার মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ বিদ্যুৎ বিল ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা মিলিয়ে মোট ১৩ কোটি টাকা দেনা মাথায় নিয়ে অস্বস্তিতে ছিলেন। এই টাকা পরিশোধের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করতে একটি পৌর মার্কেট বানানোর পরিকল্পনা হাতে নেন তিনি। এ জন্য দুই বছর আগে বাংলাদেশ মিউনিসিপ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (বিএমডিএফ) কাছে সহজ শর্তের ৫০ কোটি টাকা ঋণ চেয়েছেন এই মেয়র।
শুধু পটুয়াখালীর মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদই নন, তাঁর মতো দেশের আরও ৭০ জন মেয়র ২ বছর আগে বিএমডিএফের কাছে টাকা চেয়ে আবেদন করেছিলেন। সার্বিকভাবে ৭১ মেয়রের করা আবেদনে ঋণের পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতাধীন বিএমডিএফ থেকে এখন পর্যন্ত কেউই এক কানাকড়িও পাননি। বিএমডিএফ খুব শিগগির টাকা দিতে পারবে, সেই সম্ভাবনাও নাকি নেই। তাই অনেক মেয়র নিজ নিজ পৌরসভার অবকাঠামো উন্নয়ন এবং যথাযথভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও আবশ্যকীয় নাগরিক সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। এতে তাঁদের পৌরসভার দৈনন্দিন কাজে গতি কমেছে। তাই তাঁরা এখন বিকল্প আয়ের কথা চিন্তা করছেন
বর্তমানে সারা দেশে ৩২৮টি পৌরসভা ও ১২টি সিটি করপোরেশন আছে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো অন্যের ওপর নির্ভরশীল না থেকে নিজেদের আয়ে যাতে চলতে পারে, সে জন্য দেড় যুগ আগে গঠন করা হয়েছিল বাংলাদেশ মিউনিসিপ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (বিএমডিএফ)। অবকাঠামো উন্নয়নে ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যে গঠিত সরকারের প্রথম ও একমাত্র প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় রাজধানীর মিরপুরের গ্রামীণ ব্যাংক ভবনে। ২০০২ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিএমডিএফের যাত্রা শুরু হয়। সেই থেকে এ পর্যন্ত ১৯ বছরে বিশ্বব্যাংক তিন দফায় মোট ২৩ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ঋণের ওপর এ রকম নির্ভরশীলতাই বিপত্তি ডেকে এনেছে। কারণ, বহুজাতিক সংস্থাটি জানিয়ে দিয়েছে, তারা আর তহবিলটিতে অর্থের জোগান দেবে না। ফলে বিএমডিএফের পুরো কার্যক্রমই এখন বন্ধ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের পর থেকে কোনো পৌরসভাকে টাকা দিতে পারেনি বিএমডিএফ। সর্বশেষ ওই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কালিয়াকৈর পৌরসভার সঙ্গে ১২ কোটি টাকার ঋণচুক্তি সই করেছিল। এর পর থেকে যেসব ঋণ প্রস্তাব জমা পড়েছিল, সবই ঝুলে আছে। এ রকম দুটি পৌরসভা হলো কক্সবাজার ও চাঁদপুর। পৌরসভা দুটি ঋণ চেয়েছিল যথাক্রমে ২৬ ও ৮০ কোটি টাকা।
কেন এমন সংকট দেখা দিল, এর কারণ খুঁজেছে প্রথম আলো। তাতে জানা গেল, প্রতিষ্ঠার পর থেকে তহবিলটি ছিল শুধু বিশ্বব্যাংকের মতো একক উৎসের ওপর নির্ভরশীল। শুরুর পর মেয়রদের কাছ থেকে প্রকল্প এসেছে, আর প্রতিষ্ঠানটি অনুমোদন দিয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের বাইরে এত বছরেও বিকল্প কোনো উৎস বের করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। যাঁরা প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা কখনো সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে টাকা পাওয়ার চেষ্টা করেননি। কিংবা অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছেও যাননি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) মতো সংস্থাগুলো সরকারের উন্নয়ন বাজেট তথা এডিপি থেকে নিয়মিত টাকা পেয়ে আসছে। কিন্তু বিএমডিএফ কখনো এডিপি থেকে টাকা চায়নি। অন্যের ওপর নির্ভরশীল না থেকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো কোনো পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি গত দেড় যুগে। প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব জায়গা নেই। স্থায়ী কোনো ঠিকানা নেই। গ্রামীণ ব্যাংকের ১৩ তলা ভাড়া নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে যত জনবল থাকা প্রয়োজন, তা-ও প্রতিষ্ঠানটিতে নেই। এত বড় একটি প্রতিষ্ঠানে সাকল্যে ৩০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত। ফলে পরামর্শকের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে তাঁদের।
তবে অনেক পৌরসভা বিএমডিএফ থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছে না, এমন অভিযোগও আছে। আবার আর্থিকভাবে অসচ্ছল পৌরসভা থেকে ঋণ আদায় করতে গিয়ে বিএমডিএফের বিব্রতকর অবস্থায় পড়ার ঘটনাও রয়েছে।
সরেজমিনে ২৩ আগস্ট বিএমডিএফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় পৌর মেয়রদের পদচারণে মুখর থাকত তাঁদের অফিস। এখন আর মেয়রদের অফিসে দেখা যায় না। কারণ, মেয়ররা জানেন, তহবিলে টাকা নেই। তাই এখানে এসে লাভ নেই।
জানতে চাইলে বিএমডিএফের নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ আহমদ জামান তারিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনা বিশাল।
কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানটি এগোতে পারছে না। ঋণের জন্য ব্যাপক চাহিদা আছে। কিন্তু আমরা মেয়রদের ঋণ দিতে
পারছি না। সরকার চাইলে প্রতিষ্ঠানটিকে সচল করতে পারে।’
সাধারণত সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার আয়বর্ধক কাজের জন্য ঋণ দেয় বিএমডিএফ। সুপারমার্কেট, কাঁচাবাজার, বাস ও ট্রাক টার্মিনাল, কমিউনিটি সেন্টার, কসাইখানা, পাবলিক টয়লেট, গভীর নলকূপ স্থাপন ও পানি সরবরাহ প্রকল্পে অর্থায়ন করে প্রতিষ্ঠানটি। ৫ শতাংশ সুদে এ ঋণ দেওয়া হয়, যা পরিশোধের সময়সীমা ১০ বছর।
বিএমডিএফের কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্বব্যাংক ঋণ বন্ধ করে দেওয়ায় তাঁরাও চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন। সে জন্য তাঁরা অবশেষে এডিপি থেকে টাকা পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। বিশ্বব্যাংকের বাইরে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকেও ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে চলছে বিশ্বব্যাংককে এই প্রকল্পে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা।