ব্যাংকে ডলার ১০০ টাকা ছুঁই ছুঁই

ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করছে ৯৮-৯৯ টাকা দামে। ফলে সংকট যেন কাটছেই না।

ডলার
ছবি: সংগৃহীত

আমদানি খরচ বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় দেশে মার্কিন ডলারের চরম সংকট তৈরি হয়েছে। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেলেও তা ডলারের সংকট মেটাতে পারছে না। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডলারের দাম। এ জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিনিয়ত দামও বাড়াচ্ছে। এরপরও যেন কিছুতেই বাগে আসছে না ডলারের তেজি ভাব।

বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে ডলার বিক্রি করছে, বাজারে তার চেয়ে ৩-‍৪ টাকা বেশি দরে কেনাবেচা হচ্ছে। ফলে আমদানিকারকদের বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করেছে ৯২ টাকা ৯৫ পয়সা দরে। তবে ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় এনেছে ৯৬-৯৭ টাকায়, আর আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করেছে ৯৮-৯৯ টাকা দামে। এর আগে মে মাসে খোলাবাজারে ডলারের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়েছিল। এখন ব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রেই এ দাম ১০০ টাকা ছুঁই ছুঁই করছে। আগে ব্যাংক খাতে ডলারের বিনিময় মূল্য উঠেছিল সর্বোচ্চ ৯৭ টাকা পর্যন্ত।

এদিকে ডলার নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। একবার ডলারের দামের সীমা বেঁধে দেওয়ার পর আবার তুলে নিয়েছে। আবার বিভিন্নভাবে দাম ধরে রাখতে চাইছে। যদিও বাস্তবে দাম বেড়ে গেছে।

গত বৃহস্পতিবার বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, ওমানের একটি এক্সচেঞ্জ হাউস ৯৬ টাকা দরে প্রবাসী আয় পাঠানোর প্রস্তাব দিচ্ছে। ব্যাংকটি কিছুক্ষণ পরে সিদ্ধান্ত জানাতে চায়। ১৫ মিনিট পরে আবার যোগাযোগ করলে এক্সচেঞ্জ হাউসটি জানায়, অন্য ব্যাংক ৯৬ টাকায় সেই ডলার নিয়ে নিয়েছে। এর কিছুক্ষণ পরে কাতার থেকে ৯৭ টাকা দরে প্রবাসী আয় সংগ্রহ করে ব্যাংকটি। আর সেই ডলার আমদানিকারকের কাছে বিক্রি করেছে ৯৮ টাকা দরে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৯৩ টাকার বেশি দরে ডলার না কেনার পরামর্শ দেওয়া হয়।

বাজারে ডলার–সংকটের কারণে চলতি ২০২১–২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭০০ কোটি ডলারের বেশি বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ৪ হাজার ১০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে গত এপ্রিলে আন্তব্যাংক লেনদেনে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা, গত বৃহস্পতিবার যা বেড়ে হয়েছে ৯২ টাকা ৯৫ পয়সা।

প্রবাসী আয় আনতে ডলারের বেঁধে দেওয়া দামের সীমা তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দেওয়া হয়, বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যাংকগুলো নিজেরাই ডলারের দাম নির্ধারণ করতে পারবে। এরপর থেকে নিয়মিত বাড়ছে ডলারের দাম। টাকার মান অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি ব্যয় বাড়ছে, আর লাভবান হচ্ছেন রপ্তানিকারকেরা। সাধারণত রপ্তানিকারকদের সুবিধা দিতেই স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা হয়। রপ্তানিকারকেরা অনেক দিন ধরে এ দাবি জানিয়ে আসছিলেন, তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বাধ্য হয়ে এ পথে হাঁটছে।

জ্বালানি, খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন আমদানি পণ্যের দাম ও জাহাজভাড়া বেড়ে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আমদানি ব্যয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। আর অর্থবছরের জুলাই–মে সময়ে রপ্তানি আয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে প্রবাসী আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমে গেছে ১৬ শতাংশ। এ কারণে বেড়ে গেছে ডলারের বিনিময় মূল্যও।

ডলারের দামের বিষয়টি নিয়ে এখন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হচ্ছেন না কোনো ব্যাংকের কর্মকর্তা। কারণ, এ বিষয়ে কথা না বলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক সভায় ব্যাংকারদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এ কারণে এখন বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হচ্ছেন না ব্যাংকাররা।

সংকটেও ব্যাংকের উচ্চ মুনাফা

এদিকে ডলারের দামের অস্থিরতা রোধে বিশেষ পরিদর্শনে নেমে বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্য পেয়েছে, ব্যাংকগুলো ডলারের যে দাম ঘোষণা করছে, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি দামে লেনদেন করছে। এর ফলে কোনো কোনো ব্যাংকের মুনাফা ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অন্যদিকে ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, কিছু কিছু ব্যাংক ডলার ধারণের সীমা লঙ্ঘন করেছে, এ–সংক্রান্ত সঠিক তথ্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেয়নি। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংক গত মে মাসে ডলার লেনদেন করেই ৯৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, আগের বছরের একই মাসে এ খাত থেকে মুনাফা করেছিল ৩ কোটি টাকা।

এ জন্য বেসরকারি খাতের সাউথইস্ট, ব্র্যাক, দি সিটি, প্রাইম, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, ডাচ্‌–বাংলা, ইস্টার্ণ ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের কাছেও ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এসব ব্যাংকের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

একাধিক ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিন মাস আগেও ব্যাংক ৮৮ টাকা দরে ডলার কিনে রেখেছে। সেই ডলার এখন ৯৬-৯৭ টাকায় বিক্রি করছে। এটা কোনো অন্যায় হতে পারে না। ব্যাংকগুলোকে আমদানি বিল মেটাতে হয়, তাই ডলার কত টাকায় কেনা হলো, এটা মুখ্য বিষয় না।

এমন পরিস্থিতিতে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সংকট কমছে না। যত দিন আন্তব্যাংক বাজার চালু না হবে, তত দিন সংকট চলতেই থাকবে বলে মনে করেন ব্যাংকাররা।