সব আর্থিক সেবা মিলছে বিকাশে

মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান বিকাশের অ্যাপ
ছবি: প্রথম আলো

যাত্রা শুরুর ১০ বছরের মধ্যে সব ধরনের আর্থিক লেনদেনের বড় প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান বিকাশ। নতুন করে ঋণ ও আমানতের মতো আর্থিক সেবা যুক্ত করে প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক লেনদেনের পূর্ণাঙ্গ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ফলে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও এখন ঘরে বসেই টাকা লেনদেনের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসিতে আমানত জমা রাখতে ও সিটি ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্রঋণ নিতে পারছে।

বিকাশের অ্যাপসে সিটি ব্যাংকের ঋণ ও আইডিএলসির আমানত সেবা যুক্ত হওয়ায় অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন এ-জাতীয় সেবা দেওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করেছে বলে জানা গেছে। কারণ, আমানত ও ঋণই ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মূল ব্যবসা। আর সহজেই এ সেবা দেওয়া গেলে খরচ কমবে। ফলে অধিকসংখ্যক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দ্রুত এই সেবার আওতায় আসবে।

এদিকে ব্যাংকাররা বলছেন, বিকাশসহ নগদ, রকেটের মতো এমএফএস প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরুর পর ব্যাংকে বর্তমানে ছোট অঙ্কের লেনদেন হয় না বললেই চলে। ব্যাংকগুলো এখন এমএফএস-নির্ভর সেবার বিস্তৃতি ঘটাতে চাইছে। তবে এ প্রবণতাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদেরা। তবে তাঁরা নতুন এমএফএস সেবা চালুর অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা এবং এই সেবার খরচ কমানোর দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ প্রদান করেছেন।

বিকাশের মাধ্যমে লেনদেন করছেন একজন গ্রাহক
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

এমএফএস নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) তৌফিক আহমদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে সব ধরনের আর্থিক সেবা বেশ এগিয়েছে। আমাদের দেশে এটি মাত্র শুরু হয়েছে। এসব সেবা চালুর আগে জনগণকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। আবার যেসব প্রতিষ্ঠান সেবা দিচ্ছে, তারা কতটা ঝুঁকি বিবেচনা করে সেবাটি চালু করছে, তা-ও বিবেচনায় নিতে হবে। দেশের আর্থিক লেনদেনের বড় অংশ এখনো অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে হচ্ছে। তাই দ্রুতগতিতে সেবা ছড়িয়ে দিতে বিকাশের উদ্যোগটি ইতিবাচক।’

২০১১ সালের ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমএফএস সেবা চালু করে বিকাশ। বিকাশের ৫১ শতাংশ শেয়ার ব্র্যাক ব্যাংকের হাতে, বাকিটার মালিক বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে শুরু থেকেই বিকাশের মালিকানায় যুক্ত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মানি ইন মোশন এলএলসি। ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সদস্য ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি), ২০১৪ সালের এপ্রিলে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ও ২০১৮ সালে চীনের আলিবাবা গ্রুপের অধিভুক্ত অ্যান্ট ফিন্যান্সিয়াল (আলি-পে) বিকাশের মালিকানায় যুক্ত হয়।

বিকামের গ্রাহকসেবা
ছবি: সংগৃহীত

বর্তমানে বিকাশে ৫ কোটি ৮৫ লাখ নিবন্ধিত গ্রাহক রয়েছেন। তবে সক্রিয় আছেন অর্ধেক। এসব গ্রাহক এজেন্ট থেকে নিজের বিকাশ অ্যাপসে টাকা যুক্ত করতে পারছেন। আবার ২৯টি ব্যাংক এবং সব ব্যাংকের ভিসা ও মাস্টারকার্ড থেকেও টাকা যুক্ত করা যাচ্ছে। এসব টাকা যেকোনো বিকাশ হিসাবে পাঠানো যায়। সেই সঙ্গে আটটি ব্যাংকের হিসাবেও টাকা পাঠানো যাচ্ছে। বিকাশ হিসাবের টাকা এজেন্টের পাশাপাশি এখন ১৩টি ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকেও কম খরচে উত্তোলন করা যায়। বিকাশ দিয়ে যেকোনো মোবাইল অপারেটরে রিচার্জ ও প্যাকেজ কেনা যায়। পাশাপাশি পণ্য ও সেবার মূল্য পরিশোধ করা যায়।

গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের ইত্যাদি পরিষেবা বিলের পাশাপাশি ক্রেডিট কার্ডের বিল, স্কুলের বেতন, সরকারি মাশুলও পরিশোধ করা যায়। বিদেশ থেকে বিকাশ হিসাবে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ও আসে। এ ছাড়া ভ্রমণ টিকিট ক্রয়, বিমার প্রিমিয়ামও পরিশোধ করা যায়। পাশাপাশি বিকাশ অ্যাপসের মাধ্যমে এখন দুর্গত ব্যক্তিদের সহায়তাও করা যায়। ফলে বিকাশে এখন প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার কোটি, আর মাসে ৪৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে।

আমরা চেয়েছিলাম বিকাশকে সব ধরনের আর্থিক সেবার একটি প্ল্যাটফর্ম বানাতে। এখন বলা যায়, তার অনেকটাই পূর্ণ হয়ে গেছে। সামনে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বিকাশের সঙ্গে যুক্ত হবে। সেবা ও সংযুক্তির পরিধি যত বাড়বে, তত মানুষ সেবায় যুক্ত হবেন।
কামাল কাদীর, প্রধান নির্বাহী, বিকাশ

সম্প্রতি নতুন করে বিকাশে যুক্ত হয়েছে সিটি ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ। ফলে ৯ শতাংশ সুদে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারছেন বিকাশ গ্রাহকেরা। এর মাধ্যমে ১৫ হাজার গ্রাহক ইতিমধ্যে প্রায় ৫ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন। তবে সেবাটি এখনো সব বিকাশ গ্রাহক পাচ্ছেন না। তবে সিটি ব্যাংক শিগগির তা সবার জন্য চালু করবে বলে জানা গেছে।

ঋণের পাশাপাশি সঞ্চয়ী আমানত সেবাও চালু করেছে বিকাশ। আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসির সঙ্গে যুক্ত হয়ে এ সেবা চালু করা হয়েছে। নতুন এ সেবার মাধ্যমে ঘরে বসেই নথিপত্র জমা দেওয়ার ঝামেলা ছাড়া মাত্র দুই মিনিটে আইডিএলসিতে বিভিন্ন মেয়াদি ও অঙ্কের সঞ্চয়ী হিসাব খোলা যাচ্ছে। এ সেবায় ইতিমধ্যে ৯০ হাজার গ্রাহক প্রায় ১৪ কোটি টাকা সঞ্চয় করেছেন। এসব গ্রাহকের মধ্যে ৬৪ শতাংশ ভবিষ্যতের প্রয়োজনে, ২৫ শতাংশ আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে, ৬ শতাংশ সঞ্চয় শিক্ষা খরচের চাহিদা মেটাতে এবং বাকি ৫ শতাংশ অন্যান্য উদ্দেশে সঞ্চয় করছেন।

ঋণ বিতরণ ও সঞ্চয়ী আমানত সেবা চালুর সুবাদে বিকাশ এখন একটি পূর্ণাঙ্গ আর্থিক সেবা প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে।

জানতে চাইলে বিকাশের প্রধান নির্বাহী কামাল কাদীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম বিকাশকে সব ধরনের আর্থিক সেবার একটি প্ল্যাটফর্ম বানাতে। এখন বলা যায়, তার অনেকটাই পূর্ণ হয়ে গেছে। সামনে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বিকাশের সঙ্গে যুক্ত হবে। সেবা ও সংযুক্তির পরিধি যত বাড়বে, তত মানুষ সেবায় যুক্ত হবেন। যাঁরা বিকাশে যুক্ত, তাঁরা এসব সেবা থেকে উপকৃত হবেন।’