জীবন সহজ করে দিয়েছে মোবাইলে আর্থিক সেবা

এমএফএস ব্যবহার করে লেনদেন বাড়ছে প্রতিনিয়ত। প্রতীকী ছবিতে মডেল হয়েছেন বাবলি। ছবি: কবির হোসেন
ছবি: কবির হোসেন

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী সুবেদ আলী এখন অবসরে আছেন। তিনি ২০০৩ সালে মুঠোফোন ব্যবহার শুরু করেন। কখনো ভাবেননি এই ফোনই একসময় তাঁর কাছে আর্থিক লেনদেনের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠবে। এখন তিনি মুঠোফোনের মাধ্যমে অন্যকে টাকা পাঠানো থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক কেনাকাটা, মোবাইল রিচার্জ, বিভিন্ন পরিষেবার বিল পরিশোধ, করোনা পরীক্ষার ফি জমা দেওয়া কত কী করছেন। ২০১২ সাল থেকে তিনি এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশের গ্রাহক।

রাজধানীর খিলক্ষেতের বাসিন্দা সুবেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১২ সালের আগে কখনো চিন্তাও করিনি মুঠোফোনে বিদ্যুৎ বিল দেওয়া যাবে। এখন বিকাশে গ্রাম থেকে জমির টাকা আসে, বিভিন্ন কেনাকাটা করি, নাতি-নাতনিদের কাছে টাকা পাঠাই। প্রায় সব লেনদেনই করি বিকাশে। এতে আর অর্থ লেনদেনের জন্য ঘরের বাইরে যেতে হয় না। এই বয়সে এটাই দিয়েছে বড় রকমের স্বস্তি।’

সুবেদ আলীর মতো দেশের কয়েক কোটি মানুষের হাতে থাকা মুঠোফোনই মেটাচ্ছে নগদ টাকার চাহিদা। দেশে এখন ১৭ কোটির বেশি এমএফএস হিসাব আছে। তবে ঠিক কত মানুষ সেবাটি ব্যবহার করছেন, সেই হিসাব নেই। কারণ, একজনের একাধিক হিসাব ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। সক্রিয় ব্যবহারকারী অর্ধেকের কম বলে ধারণা করা হচ্ছে। ১২ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের দেশে এই সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

এমএফএস এখন এতটাই প্রয়োজনীয় ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে বিকাশ, নগদ, রকেট—এ ধরনের সেবা ব্যবহার করছেন না, এমন নাগরিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কারণ, এখন ঘরে বসে প্রতি মুহূর্তের আর্থিক প্রয়োজন মেটানো যায় এই সেবার মাধ্যমে। এসব সেবায় এজেন্টের পাশাপাশি সহজেই ব্যাংক বা কার্ড থেকেও টাকা জমা করা যাচ্ছে, আর যখন–তখন খরচও করা যাচ্ছে চাহিদামতো।

দেশে ২০১১ সালের মার্চে প্রথম মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) চালু করে বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। তখন তাদের সেবার নাম ছিল ডাচ্‌–বাংলা মোবাইল ব্যাংকিং, যা পরে বদলে হয় রকেট। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমএফএস সেবা চালু করে বিকাশ। পরবর্তী সময়ে আরও অনেক ব্যাংক এই সেবায় এসেছে।

সব মিলিয়ে দেশে বর্তমানে ১৪টি প্রতিষ্ঠান এমএফএস সেবা দিচ্ছে। বিকাশ, রকেটসহ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে নগদ, মাইক্যাশ, এমক্যাশ, উপায়, শিওরক্যাশ, ইসলামিক ওয়ালেট, ট্যাপ ইত্যাদি। এর মধ্যে কেবল নগদ চলছে ডাক বিভাগের অধীনে। বাকি ১৩টি বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।

বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করে জানা যায়, মোবাইলে আর্থিক সেবার (এমএফএস) বাজারে ৭০ শতাংশের বেশি বিকাশের নিয়ন্ত্রণে। ডাক বিভাগের সেবা ‘নগদ’ রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে, যেটির যাত্রা শুরু ২০১৯ সালের মার্চে। এরপরেই আছে রকেটে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা ততটা চাঙা নয়।

শুরুর দিকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শুধু টাকা পাঠানো যেত। পরে যুক্ত হয় মোবাইল রিচার্জ। এখন প্রায় সব ধরনের ছোট লেনদেনে এটির ব্যবহার হচ্ছে। বিশেষ করে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি এসব পরিষেবার বিল ও স্কুলের বেতন পরিশোধ, কেনাকাটা, সরকারি ভাতা গ্রহণ, টিকিট ক্রয়, অনুদান প্রদানের কাজে এই সেবার ব্যবহার হয়।

এদিকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা জমা করতে এখন আর এজেন্টদের কাছেও যেতে হচ্ছে না। ব্যাংক বা কার্ড থেকে সহজেই টাকা আনা যাচ্ছে এসব হিসাবে। আবার এসব হিসাব থেকে ব্যাংকেও টাকা জমা করার সুযোগ রয়েছে। ক্রেডিট কার্ড, সঞ্চয়ী আমানত এবং বিমার প্রিমিয়ামের টাকাও জমা দেওয়া যাচ্ছে। এর ফলে একটি মুঠোফোনই যেন একেকজনের কাছে যেন নিজের ব্যাংক হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া বিকাশের মাধ্যমে তো এখন সঞ্চয়ী আমানত এবং ক্ষুদ্রঋণ সেবাও মিলছে। এককথায়, বিকাশ যেন আর্থিক সেবার একটি পূর্ণাঙ্গ প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়ে উঠেছে।

আবার মোবাইলে আর্থিক সেবা শুধু সাধারণ গ্রাহকই নয়, সরকার এবং শিল্পপতিদেরও সুবিধা করে দিয়েছে। কারণ, শিল্পপতিদের এখন আগের মতো মাস শেষে ব্যাংক থেকে বস্তায় টাকা ভরে কারখানায় নিয়ে আসতে হয় না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেতন-ভাতা চলে যায় শ্রমিকদের মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবে। একইভাবে সরকারি ভাতার টাকাও সরাসরি চলে যাচ্ছে সুবিধাভোগীদের হিসাবে। এতে সরকারি অর্থের অপচয় ও অপব্যবহার কমে এসেছে বলে মনে করা হয়।

সব মিলিয়ে এসব সেবায় দৈনিক লেনদেন হচ্ছে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি। এই লেনদেন থেকেই বোঝা যায়, মানুষ সেবাটির ওপর কতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এবং এটি মানুষের জীবনের সঙ্গে কতটা মিশে গেছে।

এসব সেবা চালুর ফলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন নিম্নবিত্তরা। রিকশাচালক ও ছুটা বুয়াসহ খেটে খাওয়া মানুষেরা আগে শহর থেকে গ্রামে পরিবারের কাছে ঝুঁকি নিয়ে কষ্টার্জিত টাকা পাঠাতেন। এখন তাঁরা নিজেদের মোবাইল ব্যাংক হিসাব থেকে মুহূর্তেই টাকা পাঠাতে পারছেন।

তবে এই সেবার মাশুল এখনো অনেক বেশি বলে অভিযোগের শেষ নেই। এক হাজার টাকা তুলতে গ্রাহকদের খরচ করতে হচ্ছে প্রায় ১৫ টাকার বেশি।