জমি বেচে এননটেক্সকে ঋণ শোধের সুযোগ দিল জনতা ব্যাংক

  • এননটেক্সের কাছে বর্তমানে পাওনা ৪,৯৬০ কোটি টাকা।

  • আশুলিয়া ও টঙ্গীতে রয়েছে গ্রুপটির ৩৮৫ বিঘা জমি।

  • জমি বিক্রি করে এখন ব্যাংকের দায় শোধ করতে চায় গ্রুপটি।

  • এননটেক্সের ১৮টি প্রতিষ্ঠানের কাছে সব মিলিয়ে জনতার ঋণ ৮ হাজার ১৭৮ কোটি টাকা।

জনতা ব্যাংক

ব্যাংক খাতের আলোচিত গ্রাহক এননটেক্স গ্রুপকে জমি বিক্রি করে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক। এর মাধ্যমে গ্রাহক থেকে ঋণের মূল টাকার প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে চায় ব্যাংকটি। এননটেক্স গ্রুপ জমি বিক্রি করলেও টাকা সরাসরি জমা হবে জনতা ব্যাংকে থাকা এননটেক্সের হিসাবে। জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ব্যাংকসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।

ব্যাংকের নথিপত্র থেকে জানা যায়, আশুলিয়া ও টঙ্গীতে তুরাগ নদসংলগ্ন এক সীমানার মধ্যে ৩৮৫ বিঘা জমি রয়েছে এননটেক্স গ্রুপের, যা ব্যাংকের কাছে বন্ধক রয়েছে। বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি বা বিইউএফটি থেকে প্রকল্পটির দূরত্ব এক কিলোমিটারের কিছু বেশি। উত্তরা উত্তর (দিয়াবাড়ি) থেকে প্রকল্পটির দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। ফলে এ জমির দাম দ্রুত বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।

সম্প্রতি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। জনতা ব্যাংকের পর্ষদ চাইছে, সুবিধা দিয়ে হলেও গ্রুপটি থেকে ঋণ আদায় করতে।
আরও পড়ুন

জনতা ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০০৪ সালে জনতা ব্যাংকের শান্তিনগর শাখা থেকে প্রথম ব্যাংকিং সুবিধা গ্রহণ করে এননটেক্স গ্রুপের জুভেনিল সোয়েটার। এননটেক্স গ্রুপের কর্ণধার ইউনুছ বাদল। ওই শাখার বেশি ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা না থাকায় ২০০৮ সালে জনতা ভবন করপোরেট শাখায় ঋণটি স্থানান্তর করা হয়। ২০১০ সাল থেকে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান খুলে ঋণসুবিধা নেয় গ্রুপটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। শেষ পর্যন্ত এননটেক্স গ্রুপের ১৮টি প্রতিষ্ঠানের কাছে সব মিলিয়ে জনতা ব্যাংকের ঋণ দাঁড়ায় ৮ হাজার ১৭৮ কোটি টাকা। ব্যাংকটি একজন গ্রাহককে এত টাকা ঋণ দিতে গিয়ে সব ধরনের নিয়মকানুন লঙ্ঘন করে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এননটেক্সের কোম্পানিগুলোর নামে বিভিন্ন সময় কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হলেও টাকা পরিশোধ করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে ব্যাংক নিজেই বাধ্য হয়ে বিদেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে অর্থ শোধ করে দিয়েছে। পরে গ্রাহক সেই অর্থ পরিশোধ করেনি। এভাবে নেওয়া ঋণসুবিধার (নন-ফান্ডেড) সব অর্থই সরাসরি ঋণে (ফান্ডেড) পরিণত হয়েছে। আবার দৈনন্দিন ব্যবসা পরিচালনার জন্য নেওয়া চলতি মূলধন (সিসি ঋণ) ঋণও ফেরত দেয়নি প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে ঋণ বেড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

আরও পড়ুন

গ্রাহক ঋণ শোধে ব্যর্থ হওয়ায় ও খেলাপি হয়ে পড়ায় এককালীন ঋণ পরিশোধের শর্তে ঋণের ৩ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করার সিদ্ধান্ত নেয় জনতা ব্যাংক। সেই সঙ্গে মূল টাকার ৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা পরিশোধ করার শর্ত দেয়, যা এখন বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। তবে গ্রাহক নির্ধারিত সময়ে সেই ঋণ পরিশোধেও ব্যর্থ হয়। ওই সময়ে চট্টগ্রামের একটি শিল্পগোষ্ঠী ঋণ পরিশোধের বিপরীতে গ্রুপটির সব সম্পদ কিনে নেওয়ার আগ্রহ দেখায়, তবে শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি।

এ অবস্থায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেয়, সুদ মওকুফ বহাল রেখে আদায়যোগ্য দায় ৪ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা নির্ধারণ করে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেওয়ার। এ জন্য গত ৩০ মার্চের মধ্যে ৩০ কোটি জমা দিতে বলা হয় গ্রুপটিকে। তবে গ্রুপটি এখনো সেই টাকা জমা দিতে পারেনি। নতুন করে সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে।

এননটেক্স গ্রুপের কর্ণধার ইউনুছ বাদল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি জমি বিক্রি করে পুরো ঋণ শোধ করে দিতে চাই। জমিটি ভালো জায়গায় হওয়ায় অনেকেই কেনার আগ্রহ দেখাচ্ছে। ব্যাংকে শিগগিরই ৩০ কোটি টাকা জমা দিয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু করব। এতে ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো হবে, আমারও বিপদ কেটে যাবে।’

আরও পড়ুন

একসময় বাংলাদেশের ভালো একটি ব্যাংক হিসেবে জনতা ব্যাংকের পরিচিতি ছিল। দেশের প্রথম শ্রেণির বেশির ভাগ উদ্যোক্তা গড়ে উঠেছেন জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে। সময়ের ব্যবধানে এননটেক্স ও অর্থ পাচারে জড়িত ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাশাপাশি নানা বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এখন জনতা ব্যাংকের বড় গ্রাহক। ব্যাংকটির মোট ঋণের ৭৫ শতাংশই পাঁচটি শাখায় কেন্দ্রীভূত। যাদের বেশির ভাগের ঋণ নিয়মিত দেখানো হলেও নিয়মিত কিস্তি শোধ করছে না। এ ছাড়া একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারিতে আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে ব্যাংকটির। ২০১৭ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৫০১ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ১৯ দশমিক ২ শতাংশ। গত বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির মূলধনঘাটতি ছিল ২ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার এননটেক্স গ্রুপের ঋণের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জনতা ব্যাংকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এননটেক্স গ্রুপ। এ জন্য সুদ মওকুফ ও জমি বিক্রি করে ঋণ শোধের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে গ্রুপটি এখনো এতে সাড়া দিচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বলেছে। ফলে শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা বলা যাচ্ছে না।