ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি খোঁজা শুরু এপ্রিলেই, যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হবে

ঋণ খেলাপিপ্রতীকী ছবি

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা–ও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বলা হয়েছে, কোনো ঋণখেলাপি গ্রাহকের ঋণ বেনামিতে নেওয়া হলে ও সেই ঋণের অপব্যবহার করলে তা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করতে আগামী ৯ এপ্রিলের মধ্যে ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা শনাক্তকরণ ইউনিট’ গঠন করতে হবে। এরপরই শুরু হবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি খোঁজা।

এমন নির্দেশনা দিয়ে আজ মঙ্গলবার ‘ইচ্ছাকৃত ঋণগ্রহীতা শনাক্তকরণ ও চূড়ান্তকরণ এবং তাদের বিরুদ্ধে গৃহীতব্য ব্যবস্থা’ শীর্ষক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক এই প্রজ্ঞাপনের শর্ত লঙ্ঘন করলে তাকে কমপক্ষে ৫০ লাখ ও সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা জরিমানা করা হবে। আর শর্ত লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে প্রতিদিন এক লাখ টাকা জরিমানা করা হবে।

তবে ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শুধু খেলাপি ঋণের মধ্যে ইচ্ছাকৃত খেলাপি খুঁজে কোনো ফল আসবে না। বরং যেসব ঋণ বেনামি ও প্রতারণার মাধ্যমে নেওয়া, কিন্তু খেলাপি দেখানো হয়নি, সেসব ঋণকে তদারকির আওতায় আনতে হবে। তাহলে প্রকৃত সুফল মিলবে। এমন ঋণের পরিমাণ খেলাপি ঋণের চেয়ে বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমে হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশ। তবে এর পাশাপাশি অবলোপন করা ঋণ, পুনঃতফসিল করা ঋণ ও মামলায় থাকা ঋণকে বিবেচনায় নিলে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ হবে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা।

কারা হবেন ইচ্ছাকৃত খেলাপি
ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি যে কেউ ইচ্ছাকৃত খেলাপি হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে ব্যাংক কোম্পানি আইনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করলে এবং জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে কেউ ঋণ নিলে তা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে। এ ছাড়া যে উদ্দেশ্য ঋণ নেওয়া হয়েছে, তার বাইরে অন্য কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহার করলেও তা চিহ্নিত হবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে।

ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দুই ধাপ নিচের কর্মকর্তার অধীনে ৯ এপ্রিলের মধ্যে পৃথক ইউনিট গঠন করতে হবে। এই ইউনিট কোনো খেলাপি গ্রাহক ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি কি না, তা খুঁজে বের করবে। নতুন করে কোনো গ্রাহক খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হলে, ওই গ্রাহক ইচ্ছাকৃত খেলাপি কি না, তা ৩০ দিনের মধ্যে যাচাই করবে।

কেউ ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হলে ১৪ দিন সময় দিয়ে তার বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য চিঠি দিতে হবে। ঋণগ্রহীতার বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না হলে বা বক্তব্য উপস্থাপন না করলে ব্যাংক এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এরপর ৭ কর্মদিবসের মধ্যে গ্রাহককে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হওয়ার বিষয়টি অবহিত করে চিঠি দিতে হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি করায় গ্রাহক ক্ষুব্ধ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আপিল করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য হবে।

কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে
যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে, ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত উল্লেখ করতে হবে। তার কোনো ধরনের সুদ মওকুফ বা পুনঃতফসিল করা যাবে না। এই ঋণ অন্য কোনো ব্যাংক কিনে নিতে পারবে না। এই ঋণ পুরোপুরি শোধ না হওয়া পর্যন্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশ ভ্রমণ ও ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা দিতে পদক্ষেপ নেবে।

এসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি যাতে নতুন করে কোনো কোম্পানি খুলতে না পারেন, এ জন্যও পদক্ষেপ নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননা পাবেন না। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকাসহ গাড়ি, বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাটের নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কোনো ইচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করে নিয়মিত হলেও সহজে কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবে না। এ জন্য তাকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহককে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য দুই মাসের নোটিশ দেবে ব্যাংক এবং টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে ফৌজদারি মামলা করবে।

কী বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করেছে, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা চিহ্নিতকরণ এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে খেলাপি ঋণ কমাসহ ব্যাংকিং খাতের ঋণ শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং ব্যাংকিং খাতের দক্ষতা, সক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। ব্যাংকিং খাতের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে ব্যাংক কোম্পানির মূলধন, আয়, মুনাফা, তারল্য ও সচ্ছলতার ওপর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আরও গতিশীল করবে।

সে কারণে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চিহ্নিত করা এবং উক্ত ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক।