আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি রংপুরে, কম ঋণ করেন সিলেটের মানুষ

দেশের ব্যাংক খাতে রংপুরের মানুষ যত আমানত রাখেন তার চেয়ে বেশি ঋণ করেন। আর আমানতের তুলনায় সবচেয়ে কম ঋণ করেন সিলেটের মানুষ। তবে দেশের ব্যাংক খাতের ঋণের বড় অংশই ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। আমানত ও ঋণ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, রংপুর বিভাগ দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা। এ কারণে এই বিভাগের মানুষের মধ্যে ঋণ করার প্রবণতা বেশি। আর সিলেটপ্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা। সে জন্য সিলেট বিভাগের মানুষের মধ্যে ঋণ নেওয়ার চেয়ে সঞ্চয় করার প্রবণতা বেশি।

এদিকে দেশের ব্যাংক খাতে ঢাকা বিভাগের আমানত ১০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। একইভাবে চট্টগ্রাম বিভাগের আমানত ছাড়িয়েছে সাড়ে তিন লাখ টাকা। দেশের এ দুটি বড় বিভাগের বিপুল আমানতের ওপর ভর করে ব্যাংক খাতে সার্বিক আমানত বেড়ে গত জুন শেষে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ২৫ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুনের শেষে ব্যাংক খাতে মোট যে আমানত ছিল, তার মধ্যে ৮৩ শতাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ৫ ভাগের ৪ ভাগই এ দুই বিভাগের।

দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে ব্যাংকে সবচেয়ে কম আমানত ময়মনসিংহ বিভাগের মানুষের। চলতি বছরের এপ্রিল–জুন প্রান্তিক শেষে এ বিভাগের আমানতের পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। অথচ একই প্রান্তিক শেষে ঢাকা বিভাগের আমানত বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৪০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকায়। এ সময়ে চট্টগ্রাম বিভাগের আমানত বেড়ে হয় ৩ লাখ ৫২ হাজার ৫৩১ কোটি টাকায়।

এপ্রিল–জুন প্রান্তিক শেষে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে টাকা জমা রাখায় অর্থাৎ আমানতের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে ছিল খুলনা বিভাগ। গত জুন শেষে ব্যাংকে এ বিভাগের মানুষের আমানতের পরিমাণ ছিল ৭১ হাজার ৮ কোটি টাকা। এর পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগ। জুন শেষে রাজশাহী বিভাগের আমানতের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। সিলেট বিভাগের আমানত ছিল ৬৪ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা, রংপুরের ৩২ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা ও বরিশালের ৩১ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা।

ব্যাংকাররা বলছেন, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বড় অংশই হয় ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বড় অংশও এই দুটি বিভাগকেন্দ্রিক। এ কারণে ব্যাংক আমানতের সিংহভাগ যেমন ঢাকা-চট্টগ্রামে, তেমনি ব্যাংক ঋণের সিংহভাগও এই দুটি বিভাগে যায়।

এ বিষয়ে বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তথা ব্যবসা–বাণিজ্য ও করপোরেট কার্যক্রম ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। এ কারণে ব্যাংকের আমানত ও ঋণের সিংহভাগই এই দুই বিভাগের মধ্যে পুঞ্জীভূত থাকে। আর জাহাজভাঙা বা শিপব্রেকিং শিল্পটি চট্টগ্রামনির্ভর। এ শিল্পে ব্যাংকের বড় অঙ্কের ঋণ রয়েছে।    

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এপ্রিল–জুন প্রান্তিকে ১৬ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৪৬ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ জুনে দেশের ব্যাংক খাতে যে পরিমাণ আমানত ছিল তার প্রায় ৮৬ শতাংশই ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। ঋণ বিতরণের পর ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত আমানত থাকে প্রায় ২ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা।

বিভাগওয়ারি আমানত ও ঋণের হিসাব

গত জুন শেষে রংপুর বিভাগের আমানতের পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। আর একই সময়ে এ বিভাগে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বিভাগটিতে আমানতের তুলনায় ৫ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা বেশি ঋণ বিতরণ হয়েছে।

আমানতের তুলনায় রংপুর বিভাগে ঋণ বেশি হলেও সার্বিকভাবে সবচেয়ে বেশি ঋণ ঢাকা বিভাগে। গত জুন শেষে এ বিভাগের ১০ লাখ ৪০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা আমানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৯ লাখ ৮১ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এ বিভাগের আমানতের বিপরীতে ৯৪ শতাংশ অর্থই ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে।

আমানতের তুলনায় ঋণ কম করেন সিলেট বিভাগের মানুষ। এ বিভাগে গত জুন শেষে আমানত ছিল ৬৪ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। তার বিপরীতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১৭ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ বিভাগের আমানতের তুলনায় ঋণ বিতরণের হার ২৭ শতাংশ।

এ বিষয়ে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, রংপুর মূলত দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা। ওই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সঞ্চয় প্রবণতার চেয়ে ঋণের চাহিদা বেশি। আবার অঞ্চলটি কৃষিনির্ভর। কৃষি খাতে এখন ব্যাংকের ঋণ বিতরণের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তাই কৃষিনির্ভর এলাকা হওয়ায় এবং ঋণের চাহিদা বেশি থাকায় ওই এলাকায় আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ হচ্ছে।

আমানতের কত শতাংশ কোন বিভাগে

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে দেশের মোট আমানতের প্রায় ৬২ শতাংশই ছিল ঢাকা বিভাগের। এর পরের অবস্থান চট্টগ্রাম বিভাগের। ব্যাংকের মোট আমানতের প্রায় ২১ শতাংশ এই বিভাগের।

এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের এপ্রিল–জুন প্রান্তিকের তুলনায় ব্যাংক খাতের মোট আমানতে চট্টগ্রাম বিভাগের হিস্যা কমেছে। ২০২২ সালের এপ্রিল–জুন প্রান্তিকে মোট আমানতের ২১ দশমিক ৩২ শতাংশ ছিল এ বিভাগের। চলতি বছরের এপ্রিল–জুন প্রান্তিক শেষে তা কমে নেমে এসেছে ২০ দশমিক ৯০ শতাংশে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের এপ্রিল–জুন প্রান্তিকের তুলনায় চলতি বছরের একই প্রান্তিকে মোট আমানতে ঢাকা বিভাগের হিস্যা বাড়লেও অন্য সব বিভাগের কমেছে।