খেলাপি ঋণ কমাতে আরও ছাড়

কিস্তির ৫০ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই কেউ খেলাপি হবেন না। আগে কিস্তির ৭৫ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হতো। 

খেলাপি ঋণ
প্রতীকী ছবি

খেলাপি ঋণ যাতে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে না যায়, এ জন্য ঋণ পরিশোধে ছাড় আরও বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সুবিধার ফলে এখন কিস্তির ৫০ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই কেউ খেলাপি হবেন না। আগে খেলাপির তালিকা থেকে বাদ পড়তে কিস্তির ৭৫ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হতো। এ সুযোগ মিলবে চলতি মাস পর্যন্ত; অর্থাৎ আজ সোমবার থেকে আরও ৯ কার্যদিবস।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্যাংকঋণ পরিশোধে এ ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ সুযোগ পাবেন গত অক্টোবর থেকে চলতি মাসের মধ্যে যাঁদের কিস্তি দেওয়ার সূচি আছে, কেবল তাঁরাই। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গতকাল রোববার এক প্রজ্ঞাপন জারি করে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে।

এমন সুযোগ গণহারে না দিয়ে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দেওয়া যেত। এ কারণে ঋণের টাকা ফেরত দেওয়ার যে সংস্কৃতি, তা ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে।
মুস্তফা কে মুজেরি, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) নেতারা গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে দেখা করে ঋণ পরিশোধে ছাড় চান। তাঁরা চেয়েছিলেন, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করেও ব্যবসায়ীরা খেলাপি হওয়া থেকে মুক্ত থাকুন। বাংলাদেশ ব্যাংক পুরোটা না দিলেও তাঁদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন ছাড় দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক এমন এক সময়ে ব্যবসায়ীদের এই ছাড় দিয়েছে, যখন নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ইসলামি ধারার কয়েকটি ব্যাংকে অস্থিরতা চলছে। এসব ব্যাংক থেকে আমানত সরিয়ে নিচ্ছেন আমানতকারীরা, যা নিয়ে পুরো খাতে আলোচনা চলছে। আমানতকারীরা এসব ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে জমা করছেন। ব্যাংকের বাইরে টাকা মজুতের পরিমাণও বাড়ছে। আবার গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণও বেশ বেড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনার কারণে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনায় চাপ সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। কারণ, লক্ষ্য অনুযায়ী ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হবে সব ব্যাংক। পাশাপাশি অনেক গ্রাহক কিস্তির পুরো টাকা জমা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও এখন পিছু হটবেন।

ব্যাংকের পেশাদার ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা এ নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, এমনিতেই আমানতে চাপ তৈরি হয়েছে, অনেক ব্যবসায়ী ঋণ পরিশোধে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না, এমন পরিস্থিতিতে এই ছাড় ব্যাংকগুলোর জন্য বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। কয়েকটি ব্যাংকের তারল্যসংকট আরও প্রকট হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বহির্বিশ্বে যুদ্ধাবস্থা প্রলম্বিত হওয়ায় এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাবে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ঋণগ্রহীতাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখা এবং ঋণগ্রহীতাদের ঋণের কিস্তি পরিশোধ সহজ করতে মেয়াদি ঋণের বিপরীতে গত অক্টোবর থেকে চলতি মাস পর্যন্ত প্রদেয় কিস্তির ন্যূনতম ৭৫ শতাংশের পরিবর্তে ৫০ শতাংশ ডিসেম্বরের শেষ কর্মদিবসের মধ্যে পরিশোধ করা হলে ওই ঋণগুলো খেলাপি করা যাবে না।

প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, এ সময়ে কিস্তির যেসব টাকা বকেয়া থাকবে, তা ঋণের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। ফলে, এসব ঋণের মেয়াদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরও এক বছর বেড়ে যাবে। এ নির্দেশনার ফলে খেলাপি ঋণ সেভাবে বাড়বে না। কারণ, অর্ধেক কিস্তি দিলেই খেলাপি থেকে বাইরে থাকা যাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ব্যাংক খাতে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। খেলাপিতে পরিণত হয়েছে মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়া হয়। এর কারণে প্রায় দুই বছর ঋণ পরিশোধ না করেও কেউ খেলাপি হননি। এরপর ঋণ পরিশোধে ছাড় কিছুটা উঠে গেলে পুরোনো খেলাপিদের পাশাপাশি অনেকে নতুন করে খেলাপি হয়ে পড়েন। এর কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এমন সুযোগ গণহারে না দিয়ে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দেওয়া যেত। এ কারণে ঋণের টাকা ফেরত দেওয়ার যে সংস্কৃতি, তা ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। এসব সুযোগ যত দেওয়া হবে, ততই দিতে হবে। এ জন্য এর একটা সীমারেখা টানা উচিত। এতে ব্যাংকগুলোর তহবিলের ঘাটতি হয়ে ঋণ কমে যাবে, যার বিরূপ প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতিতে।