দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে ধুঁকছে বিডিবিএল

ছিল না দক্ষ ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক বিবেচনায় খোলা হয়েছে শাখা, দেওয়া হয়েছে ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংক ছিল নির্বিকার ভূমিকায়।

বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)

দেড় দশক আগে দুটি বিপর্যস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি) ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থাকে (বিএসআরএস) একীভূত করে গঠন করা হয় বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)। ২০১০ সালের ৩ জানুয়ারি এটি বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরু করে। দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত করার এটি একটি সফল উদাহরণ হলেও নতুন ব্যাংকটি আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। বছরের পর বছর ধুঁকে ধুঁকে চলছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বিডিবিএল।

বিএসবি ও বিএসআরএসের পুরোনো খেলাপি ঋণের বোঝা চেপে বসেছিল বিডিবিএলের ওপর। সঙ্গে যোগ হয় খেলাপি হয়ে পড়া নতুন ঋণ। ফলাফল, খেলাপি ঋণের চাপে নুয়ে পড়া ব্যাংকটি কখনোই ব্যবসাসফল হতে পারেনি। ব্যাংকিং ব্যবসার পরিবর্তে এখন শেয়ার ব্যবসা ও ভবনভাড়া বাবদ পাওয়া আয়ের ওপর নির্ভর করেই কোনোমতে টিকে আছে এটি। আবার শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেও বড় লোকসান দিয়েছে ব্যাংকটি। বিডিবিএলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক থাকার পরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।

সোনালী ব্যাংক যদি নিজেদের প্রযুক্তি ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বিডিবিএলের উন্নতি ঘটাতে চায়, তাহলে সেটা সম্ভব। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় ও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটা সম্ভব হবে না। ব্যাংক সফল করতে সদিচ্ছা কতটা আছে, এটা জরুরি।
মোহাম্মদ নূরুল আমিন, সাবেক চেয়ারম্যান, এবিবি

এবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিডিবিএল। সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদও বিডিবিএলের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্তে সম্মতি জানিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক অনুমতি মিললেই ব্যাংক দুটি একীভূত হওয়ার বাকি প্রক্রিয়া শুরু করবে।

সব দিক বিবেচনা না করে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত করার সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রে কতটা ভুল আর হিতে বিপরীত হতে পারে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ বিডিবিএল। একীভূত করেও এই ব্যাংকে দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিয়োগ দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি চলেছে রাজনৈতিক বিবেচনায় শাখা খোলা ও ঋণ দেওয়া। এসব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও তদারকি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক ছিল অনেকটা নির্বিকার ভূমিকায়। ফলে ব্যাংকটির এক-তৃতীয়াংশ ঋণই এখন খেলাপি।

বিডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাবিবুর রহমান গাজী ব্যাংকের এমন পরিণতির জন্য বেশ কিছু কারণকে দায়ী করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নতুনভাবে বিডিবিএল গঠন করা হলেও কর্মকর্তারা ছিলেন আগের, যাঁদের বাণিজ্যিক ঋণ দেওয়ার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। এর ফলে হঠাৎ অনেক নতুন ঋণ দেওয়া হয়েছে। যথাযথ যাচাই–বাছাই করে গ্রাহক নির্বাচন না করায় এসব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ে। পাশাপাশি অপরিকল্পিতভাবে শাখা খোলায় এগুলো ব্যবসাসফল হয়নি। এসব কারণে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ অন্যদের তুলনায় বেশি। তবে গত মার্চে খেলাপি ঋণ ৩৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

হাবিবুর রহমান গাজী আরও বলেন, ‘আমাদের মূলধন–ঘাটতি নেই, অন্য সূচকগুলোও ঠিক আছে। ব্যাংকের অনেক সম্পদ আছে। এখন সরকারি সিদ্ধান্ত হয়েছে একীভূত হওয়ার। সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হলে এসব সম্পদের যথাযথ ব্যবহার হবে বলে আশা করি।’

আরও পড়ুন

খেলাপি ঋণে ডুবে আছে বিডিবিএল

২০১৮ সালে বিডিবিএলে মোট আমানত ছিল ২ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালে কমে হয় ২ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। ২০২১ সালে অবশ্য আমানত আবার কিছুটা বেড়ে ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০২২ সালে তা আরও বেড়ে ২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকায় ওঠে। ২০২৩ সালে আমানত আরেকটু বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার কোটি টাকায়।

অন্যদিকে ২০১৮ সালে ব্যাংকটির দেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ১২৯ কোটি টাকায়। ২০২১ সালে ঋণ আরও বেড়ে হয় ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। ২০২২ সালে ঋণ অল্প বাড়ে, দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকায়। আর ২০২৩ সালে ঋণ অবশ্য কিছুটা কমে, নেমে আসে ২ হাজার ৩১৩ কোটি টাকায়।

তবে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের হার সব সময় উঁচুতে ছিল। ২০১৮ সালে ব্যাংকটির মোট ঋণের ৪৬ শতাংশ বা ৮৮৯ কোটি টাকা ছিল খেলাপি। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৮২ কোটি টাকায়, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ৪২ শতাংশ। তবে গত মার্চে খেলাপি ঋণের হার কমে ৩৪ শতাংশে নেমেছে বলে জানিয়েছে ব্যাংকটির কর্তৃপক্ষ। খেলাপি ঋণের এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে ব্যাংকটি কমবেশি চেষ্টা করলেও খুব একটা সফল হতে পারছে না।

আরও পড়ুন

দেশজুড়ে ২০১৮ সালে বিডিবিএলের শাখা ছিল ৪৪টি, যা এখন বেড়ে হয়েছে ৫০টি।

বিডিবিএল সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকটি ২০২২ সালে ঋণের সুদ আদায় ও আমানতের সুদ পরিশোধের পর যে টাকা আয় করেছে, তার প্রায় দ্বিগুণ অর্থ এসেছে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ থেকে। ওই বছরে ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড থেকে নিট আয় হয়েছিল ৩৯ কোটি টাকা আর শেয়ারবাজার থেকে আয় হয় ৭৫ কোটি টাকা। পুঁজিবাজারে ব্যবসা করার জন্য ব্যাংকটির বিডিবিএল সিকিউরিটিজ এবং বিডিবিএল ইনভেস্টমেন্ট নামে পৃথক দুটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ২৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক বিডিবিএল।

ঢাকার মতিঝিল ও কারওয়ান বাজার এবং চট্টগ্রাম ও খুলনায় বিডিবিএলের বহুতল ভবন রয়েছে। ২০২২ সালে ভবনভাড়া থেকে বিডিবিএলের আয় ছিল ২০ কোটি টাকার মতো। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, ঝিনাইদহ ও রাজশাহীতে মোট ২৭ বিঘা জমি রয়েছে।

বিডিবিএলের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের দিয়ে আগ্রাসীভাবে ব্যাংকিং করার কারণেই মূলত প্রতিষ্ঠানটি দুর্দশায় পড়েছে। এটা বন্ধ করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকও কোনো ভূমিকা নেয়নি।

আরও পড়ুন

যাদের কাছে আটকা ব্যাংক

বিডিবিএলের প্রায় ৯০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ৬০০ কোটি টাকাই আটকে আছে শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে। এর মধ্যে দু-তিনজন গ্রাহককে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে একীভূত হওয়া ব্যাংকটি। বাকিদের ঋণ দেওয়া হয় বিডিবিএল গঠনের পর। ব্যাংকটি এখন এসব ঋণ আদায় করতে পারছে না।

ব্যাংকের প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১২ সালে দেওয়া ঋণই সবচেয়ে বেশি খেলাপি হয়েছে। শীর্ষ খেলাপিদের মধ্যে চট্টগ্রামভিত্তিক মোস্তফা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এম এম ভেজিটেবল অয়েলের কাছে ব্যাংকটির পাওনা ১১০ কোটি টাকা। এ ছাড়া তাল্লু স্পিনিংয়ের খেলাপি ঋণ ৬৯ কোটি টাকা, আর আর স্পিনিং অ্যান্ড কটন মিলসের খেলাপি ঋণ ৬৫ কোটি টাকা এবং ডেলটা স্পিনার্স ও বিআর স্পিনিংয়ের খেলাপি ৪৭ কোটি টাকা করে। এ ছাড়া মিডিয়া ইন্টারন্যাশনালের খেলাপি ঋণ ৩৮ কোটি টাকা ও সোনারগাঁও টেক্সটাইলের খেলাপি ঋণ ৩০ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন

বিডিবিএলের যাত্রা শুরুর কিছুদিন পর এমডি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন জিল্লুর রহমান। এ পদে তিনি পাঁচ বছর ছিলেন। খেলাপি হওয়া বেশির ভাগ ঋণই তাঁর আমলে বিতরণ করা হয়। অবসরের পর তিনি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। তাঁর বক্তব্য জানতে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, একটি ব্যাংক সফল হওয়ার জন্য যে ধরনের ব্যবস্থাপনা ও পেশাদারত্ব প্রয়োজন, তা বিডিবিএলে ছিল না। সে কারণে একীভূত হওয়ার পরও এটি ভালো করতে পারেনি। এখন সোনালী ব্যাংক যদি নিজেদের প্রযুক্তি ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বিডিবিএলের উন্নতি ঘটাতে চায়, তাহলে সেটা সম্ভব। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় ও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটা সম্ভব হবে না। ব্যাংক সফল করতে সদিচ্ছা কতটা আছে, এটা জরুরি।