গত ছয় বছরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ও রূপালী ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে ঘুরেফিরে দায়িত্ব পালন করেন দুজন। তাঁরা দুই মেয়াদে তিন বছর করে ছয় বছর (২০১৬ -২০২২) দায়িত্ব শেষে গত মাসে বিদায় নিয়েছেন। এর মধ্যে ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ সোনালী ব্যাংকে প্রথম তিন বছর দায়িত্ব শেষে পরের তিন বছর রূপালী ব্যাংকের এমডি ছিলেন। আর রূপালী ব্যাংকে প্রথম তিন বছর দায়িত্ব শেষে সোনালী ব্যাংকের এমডি ছিলেন আতাউর রহমান প্রধান।
ছয় বছর করে এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর তাঁদের আর পুনর্নিয়োগ দেয়নি সরকার। যদিও তাঁদের চাকরির বয়স ছিল। ব্যাংক দুটিতে ইতিমধ্যে নতুন দুই এমডি যোগ দিয়েছেন। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের এমডি হিসেবে আফজাল করিম ও রূপালী ব্যাংকের এমডি হিসেবে যোগ দিয়েছেন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর।
ব্যাংক দুটির বার্ষিক প্রতিবেদন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ছয় বছরে সোনালী ব্যাংকের ঋণ বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। তবে প্রথম তিন বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বাড়লেও পরের তিন বছরে বাড়েনি। আর ছয় বছরে রূপালী ব্যাংকের ঋণও বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। এ সময়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েও তিন গুণ হয়েছে। দুই মেয়াদেই রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে দুই হাজার কোটি টাকা করে। যদিও ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার কারণে ঋণ খেলাপি হওয়া স্থগিত রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত ছয় বছরে সোনালী ও রূপালী ব্যাংক নিজ উদ্যোগে খুব বেশি ঋণ না দিলেও অগ্রণী ব্যাংকের জোটবদ্ধ ঋণে যোগ দিয়েছে। আর পুরোনো প্রভাবশালী গ্রাহকদের ঋণসুবিধা বাড়িয়েছে এ সময়ে। আর্থিক পরিসংখ্যান ভিন্ন ভিন্ন হলেও ব্যাংক দুটির একটি বিষয়ে রয়েছে মিল। সেটি হলো ব্যাংক দুটির সুদ আয়ের চেয়ে সুদের পেছনে খরচ বেশি।
সোনালী ব্যাংক পরিস্থিতি
২০১৬ সালের আগস্টে ব্যাংকটির এমডি হিসেবে যোগ দেন ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। এর আগে জুনে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। আর খেলাপি ছিল ৯ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। এমডির প্রথম মেয়াদকালে ২০১৯ সালের জুন শেষে ব্যাংকটির ঋণ বেড়ে হয় ৪১ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। আর খেলাপি বেড়ে হয় ১২ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। দ্বিতীয় মেয়াদের শেষে এসে গত জুনে ঋণ বেড়ে হয়েছে ৬৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। তবে খেলাপি ঋণ বাড়েনি।
২০২১ সালে সোনালী ব্যাংক ঋণ থেকে সুদ আয় করে ৩ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। আর একই বছর আমানতকারী ও অন্য খাতে সুদ বাবদ ব্যয় করে ৪ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা। ২০১১-১২ সালে হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর ব্যাংকটি ঋণ ব্যবসার চেয়ে ট্রেজারি ব্যবসায় (বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা খাটানো) বেশি মনোযোগী হয়। এ খাত থেকে গত বছর ৩ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা আয় করেছে। গত বছর শেষে ব্যাংকটির নিট মুনাফা ছিল ৩৮০ কোটি টাকা। আগের বছর যা ছিল ৩৩২ কোটি টাকা। গত ছয় বছরে ব্যাংকটির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে লন্ডনের সোনালী ব্যাংক ইউকের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া।
জানতে চাইলে ব্যাংকটির বর্তমান এমডি আফজাল করিম প্রথম আলোকে বলেন, আমি চেষ্টা করব সবার পরামর্শে ব্যাংকটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার।’
সোনালী ব্যাংকের ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটির শীর্ষ গ্রাহকদের বড় অংশই সরকারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ২০২১ সাল শেষে বিমান বাংলাদেশের ঋণ ৫ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ঋণ ৪ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা, বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশনের (বিসিআইসি) ঋণ ২ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) ঋণ ৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ঋণ ৭৯৯ কোটি টাকা, খাদ্য অধিদপ্তরের ৫৫৪ কোটি টাকা। পাশাপাশি ব্যাংকটি রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পেও ঋণপত্র সুবিধা দিয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ৬১ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া বেসরকারি ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ, হলমার্ক ও থার্মেক্স গ্রুপ।
রূপালী ব্যাংক পরিস্থিতি
২০১৬ সালের আগস্টে ব্যাংকটিতে এমডি হিসেবে যোগ দেন আতাউর রহমান প্রধান। তিন বছরের মেয়াদ শেষে ২০১৯ সালে তিনি সোনালী ব্যাংকের এমডি হন। ২০১৬ সালের জুনে রূপালী ব্যাংকের ঋণ ছিল ১৫ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। আর খেলাপির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। আতাউর রহমানের মেয়াদকালে ২০১৯ সালের জুনে এ ঋণ বেড়ে হয় ২৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এ সময় খেলাপি বেড়ে হয় ৪ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের ব্যাংকটির এমডি হিসেবে যোগ দেন ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। তার তিন বছরের মেয়াদে গত জুনে ব্যাংকটির ঋণ বেড়ে হয় ৩৭ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। আর খেলাপির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা।
২০২১ সালে রূপালী ব্যাংক ঋণ থেকে সুদ আয় করেছে ২ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। তবে এ সময়ে আমানতের বিপরীতে সুদ গুনতে হয়েছে ২ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। ট্রেজারি ব্যবসা থেকে গত বছর ব্যাংকটি আয় করেছে এক হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। গত বছর শেষে ব্যাংকটি নিট মুনাফা করে ৩৬ কোটি টাকা।
রূপালী ব্যাংকের সাবেক এমডি ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, সোনালী ও রুপালি দুই ব্যাংকে আমার সময়ে যে খেলাপি ঋণ বেড়েছে, তা ছিল কাপড়ের নিচে লুকানো খেলাপি। আমি প্রকৃত আর্থিক চিত্রকে বিশ্বাস করি, সাময়িক মুনাফাকে নয়। এ জন্য আমার সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। এর মাধ্যমে ব্যাংক দুটির বাস্তবে উপকার হয়েছে।
ব্যাংকটিতে ভালো গ্রাহকের পাশাপাশি বিতর্কিত গ্রাহকও রয়েছে। গত বছর শেষে ব্যাংকটির শীর্ষ গ্রাহক ছিল মাদার টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, যার ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের পরিমাণ ৯৮৫ কোটি টাকা, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) ঋণ ৯০৭ কোটি টাকা। নুরজাহান গ্রুপের ৬২৯ কোটি টাকা ঋণের পুরোটাই খেলাপি। জুট টেক্সটাইল মিলসের ঋণ ৬২৪ কোটি টাকা, মাদারীপুর স্পিনিংয়ের ৬১৭ কোটি টাকা, বদর স্পিনিংয়ের ৪৬২ কোটি টাকা, ডলি কনস্ট্রাকশনের ৪৬৬ কোটি টাকা ও ওরিয়ন গ্রুপের ২৮৩ কোটি টাকার ঋণ ছিল।