বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য
দৈনন্দিন খরচের জন্যই বেশি ঋণ করছেন শিল্পোদ্যোক্তারা
গত ডিসেম্বর শেষে চলতি মূলধন ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এক বছরে এই ঋণ বেড়েছে ৩৯ হাজার কোটি টাকা।
দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন দৈনন্দিন ব্যবসার খরচ পরিচালনার জন্যই বেশি ব্যাংকঋণ করতে হচ্ছে। এ জন্য তাদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বা চলতি মূলধন হিসেবে নেওয়া ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে গত বছরের অক্টোবর–ডিসেম্বর প্রান্তিকের তথ্য তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংক থেকে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নেওয়া চলতি মূলধন ঋণের স্থিতি গত ডিসেম্বর শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষে এই ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে শিল্প খাতের দৈনন্দিন ব্যবসার খরচ মেটাতে নেওয়া ব্যাংকঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আলোচ্য তিন মাসের হিসাবে এই ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা।
ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন, তাঁদের ব্যবসার খরচ বেড়ে যাওয়ায় চলতি মূলধনে টান পড়েছে। মূলত ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় ও ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে শতভাগ মার্জিন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর এই সংকট তীব্র হয়েছে। যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে কাঁচামাল আমদানিতে বেশি অর্থ খরচ করতে হয় তাদের ক্ষেত্রে চলতি মূলধনের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। আর যাদের কাঁচামাল আমদানির খরচ তুলনামূলক কম, তাদের ক্ষেত্রে এ ঘাটতি কিছুটা কম।
২০২২ সালের শেষার্ধ ও গত বছরের প্রথমার্ধে ডলারের বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা ছিল। এতে অনেক প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের লোকসান হয়েছে। সে কারণে তারা ঋণ করে ব্যবসায়িক কার্যক্রম সচল রেখেছে। এ ছাড়া ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন কাঁচামাল আমদানিতে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
ব্যাংকার, শিল্পোদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, গত এক বছরে চলতি মূলধন ঋণ বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে এ সংকট শুরু হয়। তখন একদিকে বিশ্ববাবাজারে সব ধরনের পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে দেশে ডলার সংকটের পাশাপাশি এটির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। যে কারণে ওই বছরের শেষ দিকে চলতি মূলধনঋণ দ্রুত বাড়তে শুরু করে। সব মিলিয়ে অনেক শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হয় বলে শোনা যায়।
জানতে চাইলে সিমেন্ট শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) সভাপতি মো. আলমগীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, মূলত দুটি কারণে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো চলতি মূলধনের ঘাটতিতে পড়েছে। প্রথম কারণ, ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, দ্বিতীয়ত ব্যবসার খরচ বেড়ে যাওয়া। ২০২২ সালের শেষার্ধ ও গত বছরের প্রথমার্ধে ডলারের বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা ছিল। এতে অনেক প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের লোকসান হয়েছে। সে কারণে তারা ঋণ করে ব্যবসায়িক কার্যক্রম সচল রেখেছে। এ ছাড়া ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন কাঁচামাল আমদানিতে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। দুইয়ে মিলিয়ে চলতি মূলধনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনমতে, শিল্প খাতে যে হারে চলতি মূলধন ঋণ বেড়েছে সেভাবে মেয়াদি ঋণের পরিমাণ বাড়েনি। গত ডিসেম্বর শেষে শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণের স্থিতি ছিল ৩ লাখ ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ছিল ২ লাখ ৭১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে মেয়াদি ঋণ বেড়েছে ৩০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আর গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরের শেষে মেয়াদি ঋণ বেড়েছে মাত্র ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যবসা–বাণিজ্য বা শিল্প খাতের মধ্যে গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে চলতি মূলধন ঋণে, প্রায় ১৫ শতাংশ। মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে এই হার ১১ শতাংশ। এ ছাড়া ট্রেডিং ব্যবসায়ের ঋণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সোয়া ৮ শতাংশ।
ব্যাংকার ও শিল্পমালিকেরা বলছেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক থেকে মেয়াদি ঋণ নেয় মূলত শিল্প স্থাপনসহ বিনিয়োগের জন্য। আর চলতি মূলধন ঋণ নেওয়া হয় শিল্পের দৈনন্দিন খরচ মেটাতে। শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়া মানে বিনিয়োগ অব্যাহত থাকা। মেয়াদি ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমে যাওয়া মানে শিল্পে নতুন বিনিয়োগ কমে যাওয়া বুঝায়। এ কারণে শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণের চেয়ে চলতি মূলধন ঋণ বেড়ে যাওয়াকে অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে ভালো নয় বলে মনে করেন তাঁরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি একটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে চাপে আছেন। এ কারণে তাঁরা নানাভাবে খরচ কমাচ্ছেন। যার প্রভাব পড়ছে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের চাহিদায়। এ অবস্থায় নতুন করে বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। যে কারণে মেয়াদি ঋণের চাহিদা কমেছে, এর বিপরীতে বেড়েছে চলতি মূলধন ঋণের চাহিদা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত ডিসেম্বর শেষে শিল্প খাতে মেয়াদি ও চলতি মূলধন ঋণ মিলিয়ে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ও চলতি মূলধন ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
শিল্প খাতের পর ব্যাংকের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ ট্রেডিং ব্যবসায়ে, অর্থাৎ শিল্পের বাইরে যেসব ব্যবসা–বাণিজ্য রয়েছে সেখানে যায়। এ খাতে বিতরণ করা ঋণের স্থিতি গত ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকা। তিন মাসে এ খাতে ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা।