২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

রিজার্ভে গড়া তহবিলের ঋণও ‘খেলাপি’

রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক ও বেসরকারি খাতের ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ইডিএফের ঋণ ফেরত দিতে পারছে না। এ জন্য জরিমানা গুনছে।

রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফ থেকে দেওয়া ঋণ ফেরত পাচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। কিছু রপ্তানিকারক শিল্পগ্রুপ এই ঋণ নিয়েছে, তবে সেই রপ্তানি আয় দেশে আসছে না।

আবার যেসব ব্যাংকের মাধ্যমে এই ঋণ দেওয়া হয়েছিল, সেই ব্যাংকগুলোর কাছেও ফেরত দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত ডলার নেই। ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ বা ‘খেলাপি’ হয়ে গেছে ইডিএফের ঋণ। এ জন্য জরিমানা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে ১৯৮৯ সালে গঠন করা হয় ইডিএফ, যা থেকে কাঁচামাল আমদানির জন্য উদ্যোক্তাদের ডলারে ঋণ দেওয়া হয়। একাধিক ব্যাংক সূত্রে এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

গত বছরের এপ্রিলে ডলার–সংকট শুরু হওয়ার পর ইডিএফ ঋণে সুদহার বাড়ানো হয়। এরপর চলতি বছরের মার্চে নানা নিয়মকানুন জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ইডিএফের আকার ধীরে ধীরে কমছে। ইডিএফের ঋণ ৭ বিলিয়ন বা ৭০০ কোটি ডলার থেকে কমে হয়েছে ৪১০ কোটি ডলার। ইডিএফ–সুবিধা ধীরে ধীরে বন্ধের পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কারণ, ইডিএফের ঋণকে আর রিজার্ভের হিসাবে দেখানো যাচ্ছে না। আবার রিজার্ভ বাড়াতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত রয়েছে। গত বুধবার আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩৩০ কোটি ডলার। তবে প্রকৃত বা নিট রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটি ডলারের কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভালো উদ্দেশে ইডিএফ চালু হয়েছিল। তবে ধীরে ধীরে এটা সহজে ব্যাংকঋণ পাওয়ার মতো তহবিলে রূপান্তর হয়। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপের চাপে এই সুবিধা বাড়ানো হয়। ইডিএফ ঋণ নিয়ে পণ্য রপ্তানি হলো কি না, রপ্তানি আয় দেশে এল কি না, তা দেখা হয়নি।

ফলে ইডিএফের ঋণ টাকায় রূপান্তর হওয়া, দায় আদায় করতে না পারার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের যার যেটা দায়িত্ব ছিল, তা পালন করেনি। কারণ, কোনো জবাবদিহি নেই। এর ফলে পুরো খাতটিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ডলার–সংকটের কারণে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।’

কোথায় আটকে গেছে

পণ্য রপ্তানির জন্য কাঁচামাল আমদানিতে ইডিএফ থেকে ঋণ দেওয়া হয়। এই ঋণ ফেরত দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ ২৭০ দিন সময় নিতে পারেন উদ্যোক্তারা। জানা গেছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক ও বেসরকারি খাতের ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকেরা ঋণ নিলেও তা ফেরত দিচ্ছেন না।

ব্যাংক দুটির বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবে পর্যাপ্ত ডলার নেই। ফলে এই দুই ব্যাংকের কাছে ইডিএফের প্রায় ২০ কোটি ডলার ঋণ আটকে আছে। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকেই আটকা ১৫ কোটি ডলার। এতে বন্ধ হয়ে গেছে এই দুই ব্যাংকের অন্য গ্রাহকদের ইডিএফ থেকে নতুন ঋণ পাওয়া। জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে ইডিএফের ঋণ নিয়েছিল সরকারে পদে থাকা এক ব্যবসায়ী।

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ সময়মতো রপ্তানি না হওয়ায় ও রপ্তানি মূল্য দেশে না আসায় ইডিএফের ঋণ পরিশোধ করা যায়নি। বড় যেসব গ্রুপ রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটেছে। এই দায় শোধ করতে ব্যাংকের কাছেও পর্যাপ্ত ডলার নেই। তবে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় থেকে আমরা যে ডলার পাচ্ছি, তা দিয়ে ধীরে ধীরে শোধ করা হচ্ছে। এটা আগে আরও বেশি ছিল। আরও এক-দুই মাস লাগবে, পুরো দায় শোধ করতে।’

মার্কিন ডলার
ছবি: রয়টার্স

একই অবস্থা ছিল বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংকের। ব্যাংকটির কাছেও আটকা পড়েছিল ইডিএফের ঋণ। তবে ব্যাংকটির সেই পরিস্থিতির সম্প্রতি উন্নতি ঘটেছে। ইসলামী ব্যাংক একসময় টাকা ও ডলার উদ্বৃত্ত শীর্ষ ছিল, এখন ব্যাংকটি মাঝে মাঝে ঘাটতিতে পড়ছে। ২০১৭ সালে মালিকানা পরিবর্তনের পর ব্যাংকটির এ অবস্থা দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ তারল্যসহায়তা দিয়ে ব্যাংকটির কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখছে।

ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইডিএফের যেসব ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছিল, তা জুনের মধ্যে শোধ করা হয়েছে। বিদেশি বিলের সব দায় জুলাইয়ে শোধ করা হয়েছে। ইডিএফের দায় মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার জন্য আমাদের কোনো দণ্ডসুদ দিতে হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা বিষয়টি সমাধান করেছি।’

কমছে ইডিএফ–সুবিধা

রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও রপ্তানিকারকদের উৎপাদনে সহায়তা দিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে ১৯৮৯ সালে গঠন করা হয় ইডিএফ। গত জানুয়ারি মাসে ঋণের সুদহার সাড়ে ৪ শতাংশ করা হয়, আর অনাদায়ি অর্থের ওপর অতিরিক্ত ৪ শতাংশ দণ্ডসুদ আরোপ করা হয়। ইডিএফ থেকে ঋণ নিয়েছে ৪৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান।  

এদিকে ইডিএফের বিকল্প হিসেবে ১০ হাজার কোটি টাকার রপ্তানিসহায়ক তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই তহবিল থেকে সাড়ে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে জনতা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। এই তহবিল থেকে ৪ শতাংশ সুদে টাকা নিয়ে রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারছেন রপ্তানিকারকেরা। যদিও কাঁচামালের বড় অংশই ব্যয় হয় ডলারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র সারোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইডিএফের যেসব দায় মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে, নিয়মানুযায়ী এসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। নতুন করে ঋণ দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি আগের দায় পরিশোধে তাগাদা অব্যাহত আছে।’

কারা এই ঋণ পায়

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সদস্যরা ইডিএফ থেকে দুই কোটি ডলার পর্যন্ত ঋণ নিতে পারেন। আগে একসময় এই ঋণের সীমা ছিল ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ডাইড ইয়ার্ন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিওয়াইইএ) সদস্যরা ঋণ নিতে পারেন সর্বোচ্চ ১ কোটি ডলার। আগে তাঁদের ঋণের সীমা ছিল ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি মইনুল ইসলাম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইডিএফের অর্থ লুণ্ঠন হয়ে গেছে। বিদেশি মুদ্রা পাচার হয়ে গেছে। টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। এসব দায় দিন শেষে ব্যাংকগুলোর ওপর গিয়ে পড়বে। প্রভাবশালীরা এই ঋণ নিয়েছে। তাদের কিছুই হবে না। কারণ, তাদের প্রতি সরকারের উচ্চপর্যায়ের সমর্থন রয়েছে।’