ব্যাংকের ১০% ঋণই টেকসই প্রকল্পে

দুই বছর ধরে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) টেকসই বা সাসটেইনেবল রেটিং প্রকাশ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যাতে শীর্ষ অবস্থানে থাকা ১০ ব্যাংক ও ৫ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধে কার্বন নিঃসরণ কমাতে পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে এখন অর্থায়ন করছে ব্যাংকগুলো। আবার টেকসই অর্থায়নের আওতায় এমন প্রকল্প যুক্ত হচ্ছে, যেখানে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে। এর ফলে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই শিল্পের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই দুই খাতে অর্থায়নের লক্ষ্য বেঁধে দেওয়ায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এসব খাতে অর্থায়নে নজর বাড়াচ্ছে। পাশাপাশি এখন দেশের অনেক ব্যাংক শাখা ও এটিএমে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার হচ্ছে। কাগজের ব্যবহার কমাতেও উদ্যোগ নিয়েছে কোনো কোনো ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলো টেকসই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে ২৫ হাজার ২৯০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থায়ন করেছে ৮৫৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ। টেকসই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে কৃষি, সিএমএসএমই, পরিবেশবান্ধব কারখানা, সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল প্রকল্পে অর্থায়ন। যদিও মোট ঋণের ২০ শতাংশ টেকসই প্রকল্পে হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ ছাড়া পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে ব্যাংকগুলো ১ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে, যা ব্যাংকগুলোর মোট মেয়াদি ঋণের ৩ দশমিক ১০ শতাংশ। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থায়ন করেছে ৪০৯ কোটি টাকা, যা প্রতিষ্ঠানগুলোর মেয়াদি ঋণের ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন, বর্জ্য পরিশোধনাগার বা ইটিপি নির্মাণ, পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদন অন্যতম। এই খাতে মোট মেয়াদি ঋণের ৫ শতাংশ ঋণ দেওয়ার শর্ত রয়েছে। এই দুই খাতে পুরুষ ঋণ গ্রাহকের সংখ্যা ৮ লাখ ৫৫ ও নারী গ্রাহক ৩ লাখ ৪৬৪।

টেকসই অর্থায়নে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে দুই বছর ধরে বিভিন্ন মানদণ্ডে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) টেকসই বা সাসটেইনেবল রেটিং বা মান প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিবছর ১০টি ব্যাংক ও ৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এ রেটিংয়ে যুক্ত করা হচ্ছে।

২০২১ সালে টেকসই রেটিংয়ে শীর্ষ ১০ ব্যাংক হিসেবে যারা স্বীকৃতি পেয়েছে, সেগুলো হলো ব্যাংক এশিয়া, ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ইস্টার্ণ ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক ও দি সিটি ব্যাংক। আর তালিকায় স্থান পাওয়া পাঁচ আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো অগ্রণী এসএমই ফাইন্যান্সিং কোম্পানি, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স লিমিটেড, বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেড, আইডিএলসি ফাইন্যান্স ও আইপিডিসি ফাইন্যান্স।

পাঁচটি সূচকের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক রেটিং করেছে। সূচকগুলো হলো টেকসই অর্থায়ন (সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স), পরিবেশবান্ধব শিল্পে পুনঃ অর্থায়ন (গ্রিন রিফাইন্যান্স), সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম (সিএসআর), মূল ব্যাংকিং কার্যক্রমের টেকসই সক্ষমতা (কোর ব্যাংকিং সাসটেইনেবিলিটি) ও ব্যাংকিং সেবার পরিধি (ব্যাংকিং সার্ভিসেস কভারেজ)। মূলত ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে এই রেটিং করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে টেকসই অর্থায়নের জন্য ৪০ নম্বর, মূল ব্যাংকিং কার্যক্রমের টেকসই সক্ষমতার জন্য ৪৫ নম্বর, পরিবেশবান্ধব শিল্পে পুনঃ অর্থায়ন ও সিএসআরের জন্য আড়াই নম্বর করে ৫ নম্বর এবং ব্যাংকিং সেবার পরিধির জন্য ১০ নম্বর। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি অনেকটা টেকসই, তা বলাই যায়। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে এ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে।

২০২১ সালের জন্য নির্বাচিত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাতে এরই মধ্যে মান বা রেটিং সনদ তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ৩০ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত এ-সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবির।

টেকসই রেটিং প্রকাশের বিষয়ে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আলম খান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যে সূচকগুলোর ওপর ভিত্তি করে এই রেটিং করছে, তার প্রতিটিতে পূবালী ব্যাংক ভালো করছে। টেকসই প্রকল্পে আমাদের অর্থায়ন ভালো, আবার সিএসআরেও ভালো করেছি। খেলাপি ঋণ যেমন কম, আবার শাখা-উপশাখার কারণে পরিধিও ভালো। পূবালী ব্যাংক চেষ্টা করে যাচ্ছে, এমন ভালো কাজের সঙ্গে থাকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স বিভাগ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রথম ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) টেকসই রেটিং প্রকাশের ঘোষণা দেয়। ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো রেটিংয়ে থাকা শীর্ষ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা প্রকাশ করে। এ রেটিং প্রকাশ শুরুর পর অনেক ব্যাংক পরিবেশবান্ধব শিল্প, নারী উদ্যোক্তা, কৃষি ও এসএমই ঋণ খাতে ঋণ বাড়িয়েছে। কারণ, এসব খাতের অর্থায়নকে রেটিংয়ের সূচকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। আবার যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কম, তারাও রেটিংয়ে এগিয়ে থাকছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, নির্ধারিত সূচকের মানদণ্ডের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের কোনো অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটলে তা-ও বিবেচনায় নেওয়া হয়। অনিয়ম-জালিয়াতি থাকলে ওই বছরের জন্য ওই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। পাশাপাশি একটা ব্যাংকের ভাবমূর্তি কেমন, তা-ও বিবেচনায় নেওয়া হয়। তালিকায় আসার পরও অনেক ব্যাংকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, সে ক্ষেত্রে পরের বছর ওই ব্যাংককে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময় ব্যাংকগুলোর রেটিং বা মান যাচাই করে থাকে। তবে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করতে ‘টেকসই রেটিং’ প্রকাশ করা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোকে এ জন্য সনদও দেওয়া হচ্ছে। টেকসই অর্থায়ন ও সামাজিক দায়বদ্ধতার ওপর ভিত্তি করে শুরুতে এই রেটিং করা হয়। এখন খেলাপি ঋণের হার, নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ এবং বড় আকারের ঋণের হারকেও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি একটি ব্যাংক সেবার পরিধি কতটা ছড়িয়ে দিতে পারল, তা-ও দেখা হচ্ছে। ফলে এই রেটিংয়ের মাধ্যমে এখন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা বিবেচনা করা যায়।