আইএমএফের চাওয়া মেনে নেওয়া শুরু

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)ছবি: রয়টার্স

আইএমএফ প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছে।চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই ঋণ পেতে কিছু পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে সরকার।

  • সরকারি চার ব্যাংককে জুনের মধ্যে ১২%-এ নামিয়ে আনতে হবে খেলাপি ঋণ। 

  • রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়ন শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

  • ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ।

ঋণ পেতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাওয়া বা শর্ত পূরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। এর অংশ হিসেবে ভর্তুকি ও ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে উদ্যোগ নিয়েছে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ২০ শতাংশ বাড়ানোর আবেদন করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। আর রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আগামী জুনের মধ্যে ১২ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়ন করতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আইএমএফ এবার যেসব শর্ত দিচ্ছে, তা খুবই নমনীয়। এসবও যদি মানতে না পারি, তাহলে বুঝতে হবে, আমরা সমস্যার সমাধান চাই না
আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক পিআরআই
আরও পড়ুন

আগামী ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে আইএমএফের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠেয় পর্ষদ সভায় বাংলাদেশের ঋণ অনুমোদন হওয়ার কথা। এর আগে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার অংশ হিসেবে গত ২৬ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় দুই সপ্তাহের বৈঠক করে গেছে আইএমএফের একটি দল। দলটি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে দফায় দফা বৈঠক করে।

এতে বিভিন্ন চাওয়া তুলে ধরা হয়। ফলে ঋণের চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই বাংলাদেশ এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। মোটা দাগে আইএমএফের চাওয়ার মধ্যে আছে, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনাসহ ব্যাংক খাতের নানা সংস্কার, সরকারের ভর্তুকি ব্যয় কমিয়ে আনা এবং রাজস্ব খাতের সংস্কার।

আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইএমএফের যেসব শর্তের কথা শোনা যাচ্ছে, তা মানা উচিত। এসব নিয়ে কারও কোনো দ্বিমত করা ঠিক হবে না। এবার যেসব শর্ত দিচ্ছে, তা খুবই নমনীয়। এসবও যদি মানতে না পারি, তাহলে বুঝতে হবে, আমরা সমস্যার সমাধান চাই না।’

‘বেশ কিছু ঋণ খারাপ হয়ে পড়ায় খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি তা কমিয়ে আনার। নির্দেশনা মেনে ১২ শতাংশে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
মুরশেদুল কবীর, অগ্রণী ব্যাংকের এমডি

ব্যাংক খাত সংস্কার

আইএমএফ ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলেছে। এখন বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের কম হলেও সরকারি খাতে তা ২০ শতাংশের বেশি। এ অবস্থায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংককে আগামী বছরের জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১২ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক চারটি হলো সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী। তবে কোন কৌশলে খেলাপি ঋণ কমাবে, তার কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে সভা করে এই নির্দেশনা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মুরশেদুল কবীর এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেশ কিছু ঋণ খারাপ হয়ে পড়ায় খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি তা কমিয়ে আনার। নির্দেশনা মেনে ১২ শতাংশে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’ জনতা ব্যাংকের এমডি আব্দুছ ছালাম আজাদও একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে আমরা কাজ শুরু করেছি। ঋণ আদায় ও পুনঃ তফসিলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের অংশ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেসিক ব্যাংকের। ব্যাংকটির ৫৯ শতাংশ ঋণই খেলাপি। বিডিবিএলের খেলাপি ঋণ ৪০ শতাংশ।

এ ছাড়া জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৮ শতাংশ, অগ্রণী ব্যাংকের ১৯ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকের সাড়ে ১৭ শতাংশ ও সোনালী ব্যাংকের ১৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, গণহারে পুনঃ তফসিল ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি–সহায়তা পেলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে। তবে প্রকৃতপক্ষে ঋণ আদায় হবে না, খেলাপিও কমবে না। বরং কাউকে কাউকে খেলাপি থেকে বের করে নতুনভাবে ঋণ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। প্রয়োজনে বড় কাউকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে ঋণ আদায় করা।

আরও পড়ুন

রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়ন

২০২০-২১ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত ছিল ৪ হাজার ৬৪০ কোটি ডলার। গত জানুয়ারিতেও রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৪৯৫ কোটি ডলার। আমদানি বাড়ায় ও ডলার–সংকটের কারণে প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে রিজার্ভ কমে হয়েছে ৩ হাজার ৪০৭ কোটি ডলার।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাবায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে বলেছে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। কারণ, রিজার্ভ থেকে ৭০০ কোটি ডলার দিয়ে গঠন করা হয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফ। গঠন করা হয়েছে লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ) ও গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ)। বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজ কিনতেও রিজার্ভ থেকে সোনালী ব্যাংককে অর্থ দেওয়া হয়েছে। পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতেও রিজার্ভ থেকে অর্থ দেওয়া হয়েছে। এসব খাতে সব মিলিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে ৮০০ কোটি ডলার।

এসব বিনিয়োগকে বাদ দিয়ে রিজার্ভ হিসাবায়ন করতে বলেছে আইএমএফ। এতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। ফলে প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ হয় ২৬ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।

এর ধারাবাহিকতায় ৯ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন। তার থেকে ৮ বিলিয়ন বাদ দিলে প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ বের হবে।

গভর্নর সেদিন প্রকৃত রিজার্ভ কত, তা সরাসরি না বললেও গতকাল প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান মেহেরপুরের মুজিবনগরে আইএফআইসি ব্যাংকের এক অনুষ্ঠানে বলেন, দেশের রিজার্ভ নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণসহ দেশে রিজার্ভ আছে ২৬ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে চলবে ছয় মাস।

গত সেপ্টেম্বরে আমদানি খরচ হয়েছিল ৭ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। ফলে ২৬ বিলিয়ন ডলার দিয়ে চার মাসের কিছু কম সময়ের আমদানি খরচ মেটানো যাবে।

এ ছাড়া বাজারভিত্তিক সুদহার চালু ও ডলারের দামের লাগাম তুলে দিতে বলেছে সংস্থাটি।

সরকারি ভর্তুকি কমানো

আইএমএফের চাওয়া, সরকারের ভর্তুকি কমানো। সরকার বেশি ভর্তুকি দেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও কৃষি খাতে। এর আগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। আর ২১ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

এরপর গত বুধবার ভোক্তা পর্যায়েও দাম বাড়াতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মূল্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির কাছে আবেদন করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। পরের দিন বৃহস্পতিবার আরও দুটি কোম্পানি দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে।

বিদ্যুতের দাম বাড়ালে এর প্রভাব পড়ে সব খাতে। এতে বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি। বড় একটা শ্রেণির জীবন চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। এর আগে গত জুন মাসে গ্যাসের দাম এবং গত আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়।