কমেছে সুদহার, আমানত হারাচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান

ব্যাংকগুলো যেখানে আমানতের বিপরীতে ৮% পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে, সেখানে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দিতে পারে সর্বোচ্চ ৭%।

ব্যাংকের চেয়ে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফআই) টাকা রাখলে বেশি সুদ পাওয়া যায়। দীর্ঘদিন ধরে এমনটাই চলে আসছিল। কিন্তু দিন বদলেছে। এখন অনেক ব্যাংকই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আমানতে বেশি সুদ দিচ্ছে।

কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সব ধরনের আমানতে সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৭ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের সর্বোচ্চ কোনো সীমা নেই, বরং সর্বনিম্ন সীমা রয়েছে। একই বাজারে কারও জন্য সর্বোচ্চ সীমা,আবার কারও জন্য সর্বনিম্ন সীমা থাকাতেই জটিলতা তৈরি হয়েছে।

সুদহার কম হওয়ায় বিভিন্ন এনবিএফআই থেকে নিজেদের টাকা তুলে নিচ্ছেন সাধারণ গ্রাহক, করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক। আবার কেউ কেউ মেয়াদ শেষ হলে আর তা নবায়ন করছেন না। ফলে এনবিএফআইগুলো তহবিল ব্যবস্থাপনা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।

এনবিএফআইগুলো সর্বনিম্ন তিন মাস মেয়াদে টাকা জমা নিতে পারে। এখনো দেশের বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ঋণ দিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক আমানত যাদের যত বেশি, তারা তত ভালো অবস্থানে আছে।

এদিকে গতকালও কলমানি বাজারে (ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরস্পরের কাছ থেকে স্বল্প মেয়াদে নেওয়া ধার) সর্বোচ্চ সাড়ে ১০ শতাংশ সুদে টাকা লেনদেন হয়েছে। ট্রেজারি বিলের সুদহারও ৮-৯ শতাংশ পর্যন্ত উঠছে। শুধু এনবিএফআইগুলোর আমানতের ওপর সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ সীমা দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানতে চাইলে দেশের শীর্ষস্থানীয় এনবিএফআই লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খাজা শাহরিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘৭ শতাংশ সুদ বেঁধে দেওয়ায় এখন জমার চেয়ে বেশি টাকা নগদায়ন হচ্ছে। ব্যাংকগুলোও ৮-৯ শতাংশের কম সুদে টাকা দিতে চাইছে না। এর কম সুদ দিলে আগের তহবিলও ধরে রাখা যাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে আমরা বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে গেছি।’

চলতি বছরের জুলাই থেকে এনবিএফআইগুলোকে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ সুদে আমানত নিতে পারবে বলে সিদ্ধান্ত দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণ করা হয় ১১ শতাংশ। আর ব্যাংকগুলোর জন্য ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এর দেড় বছর পর জানায়, মেয়াদি আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার তিন মাসের মূল্যস্ফীতির কম হবে না। তারল্য-সংকট ও মূল্যস্ফীতি বাড়ায় অনেক ব্যাংক এখন মেয়াদি আমানতের সুদহার বাড়িয়ে ৮ শতাংশ পর্যন্ত করেছে।

জানা গেছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক থেকে একটি শীর্ষপর্যায়ের এনবিএফআই সাড়ে ৮ শতাংশ সুদে ৬ মাস মেয়াদে ২০ কোটি টাকা আমানত নিয়েছিল। সম্প্রতি সেটির মেয়াদ শেষ হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি নির্দেশনা মেনে ৭ শতাংশ সুদ দেওয়ার প্রস্তাব করে। এতে ব্যাংকটি রাজি হচ্ছে না।

এদিকে এনবিএফআই স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্সে সাড়ে ৮ শতাংশ সুদে রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক ১৫০ কোটি টাকা রেখেছে। প্রতিষ্ঠানটি থেকে একই হারে সুদ নিচ্ছে সোনালী ব্যাংকও। অগ্রণী ব্যাংক আভিভা ফাইন্যান্স (সাবেক রিলায়েন্স) থেকে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ হারে এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট থেকে সাড়ে ৮ থেকে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে সুদ নিচ্ছে।

একইভাবে সব সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদে এনবিএফআইগুলোতে টাকা জমা রেখেছে। এর মধ্যে যেসব আমানতের মেয়াদ শেষ হচ্ছে, তা নবায়ন ও নগদায়ন নিয়ে জটিলতা দেখা দিচ্ছে। কারণ, এনবিএফআইগুলোর ৭ শতাংশের বেশি সুদ দেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

একটি এনবিএফআইয়ের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তা বলেন, এই এক নির্দেশনার কারণে ভালো-খারাপ সব এনবিএফআই নিয়ম না মানার তালিকায় (নন-কমপ্লায়েন্স) পড়ে গেছে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি এনবিএফআইয়ে গত জুনে সাধারণ মানুষের আমানত ছিল ৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা, যা গত মঙ্গলবার কমে হয়েছে ৪ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। আর প্রতিষ্ঠানটিতে গত জুনে ব্যাংকের আমানত ছিল ৪৬০ কোটি টাকা, যা গত মঙ্গলবার কমে হয়েছে ৩৩৫ কোটি টাকা। একই অবস্থা অন্য কয়েকটি এনবিএফআইয়েরও।

জানতে চাইলে ডিবিএইচ ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাসিমুল বাতেন প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকের চেয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদহার বেশি হয়ে গেছে। এতে অনেক প্রতিষ্ঠানের তহবিলে টান পড়ছে, যা আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।

এদিকে বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার সংশ্লিষ্ট চারটি এনবিএফআইয়ের কারণে পুরো খাতটি আস্থার সংকটে পড়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখন কড়া নজরদারি শুরু করেছে ও নতুন নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করছে।

সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতিতে এনবিএফআইগুলোর অংশগ্রহণ দিন দিন কমে আসছে। যদিও নতুন নতুন এনবিএফআই অনুমোদন দেওয়া অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সর্বশেষ নগদ ফাইন্যান্সকে প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে দেশের ঋণের ৭ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর। এরপর নতুন নতুন আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রমে এলেও ২০২১ সালে এই ঋণ কমে ৫ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে।