মৌলিক পাঁচ খাতে অর্থায়ন করে তালিকায় পূবালী
দুই দশক আগেও পূবালী ব্যাংক ছিল সমস্যায় পড়া পুরোনো ধাঁচের একটি ব্যাংক। সেবার মানের পাশাপাশি ব্যাংকটির শাখাগুলোও ছিল জরাজীর্ণ। একসময় আর্থিক সংকটে থাকা পূবালী ব্যাংক এখন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকগুলোর একটি। ভালো গ্রাহক, কম খেলাপি ঋণ, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, সেবার মান ও উত্তম চর্চার কারণে দেশের ভালো ব্যাংকগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে এটি। বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বেশি শাখা-উপশাখা পূবালী ব্যাংকের। ডিজিটাল সেবাতেও বেশ এগিয়ে ব্যাংকটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের টেকসই ব্যাংকের তালিকাতেও স্থান করে নিয়েছে পূবালী ব্যাংক।
ব্যাংক–সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পূবালী ব্যাংকের সবচেয়ে বড় পরিচয় ব্যাংকটির ঋণের সবই মৌলিক চাহিদানির্ভর। ব্যাংকটির ঋণের বড় অংশ খাদ্য ও খাদ্যসামগ্রী এবং বস্ত্র ও বস্ত্র–সংশ্লিষ্ট খাতে। এ ছাড়া বাসস্থান, হাসপাতাল ও শিক্ষা খাতে ব্যাংকটি বড় ধরনের অর্থায়ন করেছে। যার বড় অংশ পরিবেশবান্ধব ও সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। ঋণের এমন বৈচিত্র্যময় চিত্র অন্য ব্যাংকে দেখা যায় না।
বাঙালি মুসলিম উদ্যোক্তাদের হাত ধরে ১৯৫৯ সালে এ ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়। তখন নাম ছিল ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ব্যাংকটি জাতীয়করণ করা হয়, নাম রাখা হয় পূবালী ব্যাংক। জাতীয়করণের পর বিভিন্ন সরকারের মেয়াদে ব্যাংকটিতে নানা ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে। তাতে ১৯৮৪ সালে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৫৪ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকটিকে আবার বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয় সরকার। ১৬ কোটি টাকায় ১৯৮৪ সালে ব্যাংকটির শেয়ার বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাতে স্বাধীনতার আগে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের অনেকে আবার যুক্ত হন ব্যাংকটির সঙ্গে। তাঁদের অনেকেই বা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা এখনো ব্যাংকটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
বেসরকারি খাতে আসার পর উদ্যোক্তারা ব্যাংকটির সংস্কারে হাত দেন। তারই অংশ হিসেবে শুরুতে কর্মীদের মধ্যে সেবা দেওয়ার মানসিকতার উন্নতি ঘটানো হয়। পাশাপাশি জোর দেওয়া হয় ঋণ আদায়ে। ২০০৫ সালে পূবালী ব্যাংক সমস্যাযুক্ত ব্যাংক থেকে বেরিয়ে আসে। ২০০৭ সালে ব্যাংকটি থেকে পর্যবেক্ষক সরিয়ে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন পূবালী ব্যাংক একজন গ্রাহককে তাঁর পুরো জীবনে সেবা দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। পাশাপাশি কোনো গ্রাহক ব্যাংক ছেড়ে চলে গেলে এর জন্য শাখা ব্যবস্থাপককে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়। ২০০৯ সালে কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার (সিবিএস) চালু করে ব্যাংকটি। এর পর থেকে প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে থাকে পূবালী ব্যাংক। একই সময়ে ভিসা, মাস্টারকার্ড, কিউ ক্যাশ কার্ড সেবা, নিজস্ব এটিএম ও সিআরএম সেবা চালু করা হয়। সেই সঙ্গে গ্রাহকদের জন্য নতুন নতুন সেবা চালু করে। পরিবর্তন আনা হয় ব্যাংকের সাজসজ্জায়ও। কর্মীদের প্রত্যেককে কম্পিউটার দেওয়া হয়। নিশ্চিত করা হয় সুশাসন। এ ছাড়া ব্যাংকটি তার কর্মীদের সর্বোচ্চ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এভাবে ধীরে ধীরে ব্যাংকটি পৌঁছে যায় শীর্ষ পর্যায়ে। গত বছর ব্যাংকটি ৭৬২ কোটি টাকা নিট মুনাফা করে।
১৯৮৪ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৫৪ শতাংশ। সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ কমে ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশে নেমেছে। শুধু খেলাপি ঋণ নয়, নানা উদ্যোগ ও সুশাসনের মাধ্যমে আর্থিক বিভিন্ন সূচকে ব্যাংকটিকে শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকে পরিণত করা হয়েছে। শুধু ২০২৪ সালে ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা।
ব্যাংকটির নথিপত্র অনুযায়ী, ১৯৮৪ সালে ব্যাংকটির আমানত ছিল ৫৪১ কোটি টাকা আর ঋণ ছিল ৪৩৩ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২৪ সালে পূবালী ব্যাংকের আমানত বেড়ে হয়েছে ৭৪ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এ সময় ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন এখন ১ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। আর কর্মীর সংখ্যা ১০ হাজার ৬৮৭ জন। সারা দেশে ৫০৮টি শাখা ও ২২৭টি উপশাখা রয়েছে ব্যাংকটির। বর্তমানে বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বেশি নেটওয়ার্ক পূবালী ব্যাংকের।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকার বেশির ভাগ বড় হাসপাতাল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণে আমরা অর্থায়ন করেছি। বিদেশে যেতে শিক্ষার্থীদের ফাইল আমরা সবচেয়ে বেশি খুলেছি ও গ্যারান্টি সুবিধা দিয়েছি। এ ছাড়া খাদ্য আমদানি ও পোশাক রপ্তানির বড় অংশ আমাদের মাধ্যমে হয়ে থাকে। পূবালী ব্যাংক পুরো পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিচালিত হয়, যা ব্যাংকটির আর্থিক ভিত্তি সুসংহত করতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।’