ব্যাংকারদের বাড়িভাড়ার ওপর আয়কর, ‘অন্যায্য’ মনে করে রাষ্ট্রমালিকানাধীন পাঁচ ব্যাংক

এই পাঁচ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে গণ্য করছে না আইআরডি। তাই আইআরডি সচিবের ব্যাখ্যা চেয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

আপত্তি সত্ত্বেও রাষ্ট্রমালিকানাধীন পাঁচ বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাড়িভাড়ার ওপর কর নিচ্ছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি)। ব্যাংকগুলো হলো সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)। তবে এই কর নেওয়াকে অন্যায্য দাবি করে অর্থমন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, আইআরডি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে কয়েক দফায় আবেদন করেছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু তারা কোনো প্রতিকার পায়নি।

ব্যাংকগুলোর যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর মূল বেতন ১৬ হাজার টাকার বেশি, তাঁরা সেই বেতন, প্রণোদনা ও উৎসব বোনাসের ওপর আয়কর দিয়ে আসছেন। অথচ সরকারি চাকরিজীবীদের বাড়িভাড়া আয়করমুক্ত। কিন্তু আইআরডির মনোভাব এমন যে এই পাঁচ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারি চাকরিজীবী নন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২২ সাল পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মোট জনবল ৪৯ হাজার ৬১৭ জন, যার মধ্যে এই পাঁচ ব্যাংকেই রয়েছেন প্রায় ৪০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী।

বিষয়টি নিয়ে কয়েক বছর ধরেই জটিলতা চলছে। তা নিরসনে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিষয়টি স্পষ্টীকরণের আহ্বান জানিয়ে আইআরডিকে চিঠি পাঠায়। আইআরডি গত এক বছরেও এ–সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানায়নি। সম্প্রতি একই বিষয়ে আবার চিঠি পাঠিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এই বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি বিষয়টি সম্পর্কে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

বেসামরিক প্রশাসনের জন্য ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় বেতনকাঠামোর প্রজ্ঞাপন জারির পর স্বশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান; ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং বিচার বিভাগের জন্যও আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। বিদ্যমান জাতীয় বেতনকাঠামোর আওতায় চাকরি [স্বশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান] (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ, ২০১৫ নামে ৩৭০ এবং চাকরি [ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান] (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ, ২০১৫ নামে ৩৭১ নম্বর প্রজ্ঞাপন জারি রয়েছে।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন পাঁচ বাণিজ্যিক ব্যাংক নিজেদের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে কয়েক বছর ধরে ৩৭১ নম্বর প্রজ্ঞাপন অনুসরণ করে আসছে। কিন্তু এ প্রজ্ঞাপনে পাঁচ ব্যাংকের নাম অন্তর্ভুক্ত না থাকায় করযোগ্য আয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে তারা দুই বছর ধরে প্রজ্ঞাপনটি অনুসরণ করা বাদ দেয়। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্ত করা আছে ৩৭০ নম্বর প্রজ্ঞাপনে। ২০১৮ সালে প্রণীত সরকারি চাকরি আইনেও বলা আছে, যেসব প্রতিষ্ঠানে ৫০ শতাংশের বেশি সরকারের শেয়ার থাকবে, সেগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হবে।

জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বহুদিন ধরে এটা নিয়ে জটিলতা চলছে। আইআরডি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাড়িভাড়ার ওপরও আয়কর নেওয়া শুরু করেছে। এর একটা স্পষ্টীকরণ জরুরি।

এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এক চিঠিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানিয়েছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ৩৭০ নম্বর প্রজ্ঞাপন অর্থাৎ চাকরি [স্বশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান] (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ, ২০১৫ অনুসরণ করতে পারে। ফলে ব্যাংকগুলোর নাম ৩৭১ নম্বর অর্থাৎ চাকরি [ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান] (বেতন ও ভাতাদি) আদেশে অন্তর্ভুক্ত করার দরকার নেই। তবে ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আয়কর নির্ধারণের বিষয়টি আইআরডির সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হতে পারে।

এর মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন পাঁচ ব্যাংকও আলাদা আলাদা চিঠিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানিয়েছে যে যার যার পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা ৩৭০ নম্বর প্রজ্ঞাপনই অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আইআরডি–সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমকে এসব কথা জানিয়ে গত ১১ ফেব্রুয়ারি চিঠি পাঠিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। চিঠিতে বলা হয়, বিষয়টি নিষ্পত্তি বা স্পষ্টীকরণের জন্য ২০২৩ সালের ২১ মার্চ আইআরডিকে চিঠি পাঠানো হলেও দপ্তরটি এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত বা মতামত দেয়নি।

আইআরডি–সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমকে মুঠোফোনে না পেয়ে বিষয়টি উল্লেখ করে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে খুদে বার্তা দেওয়া হয়। তিনি কোনো জবাব দেননি।

এদিকে আইআরডির সাবেক সচিব মো. আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, আইআরডি আইন অনুযায়ীই করছে বলে মনে হয়। কেউ সংক্ষুব্ধ হলে আদালতে যেতে পারেন। কোনটা ন্যায্য, এটা বলা কঠিন।

ব্যাংকাররা বলছেন, রাষ্ট্রমালিকানাধীন এ পাঁচ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকারি কর্মচারী হিসেবেই গণ্য করছে না আইআরডি। যে কারণে বাড়তি আয়কর আদায়ে দিনের পর দিন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নোটিশ দিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন কর সার্কেল। কাউকে কাউকে জরিমানাও গুনতে হচ্ছে।

তবে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), কর্মসংস্থান ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না। আইআরডির বিবেচনায় এসব ব্যাংকের লোকেরা সরকারি কর্মচারী। ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কর্মকর্তা থেকে জ্যেষ্ঠ ও প্রিন্সিপাল অফিসারদের এখন বছরে ৩০ থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি আয়কর দিতে হচ্ছে। আর সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) থেকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দেড় লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়তি দিতে হচ্ছে।