যে বিবেচনায় দেওয়া হতে পারে ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স

সরকারের পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচনের আগেই কাঙ্ক্ষিত ডিজিটাল ব্যাংক চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। আজ জানা যাবে, কারা কারা লাইসেন্স পাচ্ছে।

দেশে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল ব্যাংক আসছে। এই ব্যাংক গঠনের নীতিমালা ইতিমধ্যে তৈরি করা হয়েছে। লাইসেন্স পাওয়ার জন্য ৫২টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। আজ রোববার দুপুরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় সিদ্ধান্ত হতে পারে, কারা কারা লাইসেন্স পাচ্ছে। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আজকের সভার আলোচ্যসূচিতে ডিজিটাল ব্যাংকের বিষয়টি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচনের আগেই বহুল কাঙ্ক্ষিত ডিজিটাল ব্যাংক চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।

দেশে এর আগে প্রচলিত ধারার ব্যাংক অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পেত। তাই রাজনৈতিক নাকি পেশাদারত্ব, কোন বিবেচনায় ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স অনুমোদন করা হয়, তা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।  

এদিকে ডিজিটাল ব্যাংকের আবেদন পর্যালোচনার সঙ্গে যুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ৫২টি আবেদন যাচাই–বাছাই করে ৩৭টি চূড়ান্ত করা হয়েছিল। এরপর তালিকা আরও ছোট করে ২০টিতে নামিয়ে আনা হয়।

কিন্তু প্রাথমিক যাচাই–বাছাইয়ে যাদের বাদ দেওয়া হয়েছিল তাদের নামই এখন পর্ষদ সভায় উপস্থাপন করতে হচ্ছে। তাদেরই এই লাইসেন্স দেওয়া হতে পারে। ব্যাংক খাতের এই বেহাল পরিস্থিতির মধ্যে অযোগ্যদের লাইসেন্স দেওয়া হলে আমানতকারীদের আস্থা আরও তলানিতে নেমে আসবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পুরো খাতে।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডিজিটাল ব্যাংক দিতে হবে, তবে অর্থনীতির এই অস্থিরতার মধ্যে এটা দেওয়ার জন্য ভালো সময় না। নির্বাচনের পর অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলে ভালো মানের প্রযুক্তি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাইসেন্স দেওয়া যেতে পারে।

তবে দুই-তিনটির বেশি দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না। তিনি আরও বলেন, কাউকে খুশি করতে এখন এই লাইসেন্স দেওয়া হতে পারে। এটা হলে আর্থিক খাতে অস্থিরতা বাড়বে, সম্ভাবনার খাতটি নষ্ট হয়ে যাবে।  

কারা আবেদন করেছে

ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য ৫২টি আবেদন পড়লেও এর সঙ্গে জড়িত প্রায় পাঁচ শ প্রতিষ্ঠান। কারণ, প্রতিটি আবেদনের সঙ্গে ১০টির মতো প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস), স্টার্টআপ, মোবাইল অপারেটর, গ্যাস পাম্প কোম্পানি, ওষুধ কোম্পানি, ঢেউ শিট উৎপাদনকারী ও বিদেশি আর্থিক প্রযুক্তি (ফিনটেক) কোম্পানি রয়েছে।
দেশের শীর্ষ এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ আবেদন করেছে। তাদের প্রস্তাবিত নাম বিকাশ ডিজিটাল ব্যাংক। এর সঙ্গে বিকাশের উদ্যোক্তা ব্র্যাক ব্যাংকসহ যুক্তরাষ্ট্রের ‘মানি ইন মোশন, ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি), বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, অ্যান্ট গ্রুপ ও সফটব্যাংক ভিশন ফান্ড যুক্ত।

আরেক এমএফএস নগদের প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানের নাম ‘নগদ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি’। এই উদ্যোগে রয়েছে নগদের বর্তমান উদ্যোক্তা, সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান ফরিদ খানসহ আরও বেশ কয়েকজন। মোবাইলে আর্থিক সেবার পূর্ণ লাইসেন্স পায়নি নগদ, তাই ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়ে নগদকে পরিচালনার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।  

নগদ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর এ মিশুক প্রথম আলোকে বলেন, নগদ ডিজিটাল ব্যাংক হবে দেশের মানুষের স্বপ্নপূরণের ব্যাংক। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে আর্থিক লেনদেনে যে সুপারসনিক গতি প্রয়োজন, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আবর্তিত হবে ডিজিটাল ব্যাংকের সেবা কার্যক্রম। ক্ষুদ্রঋণ ও সঞ্চয় সেবা আর্থিক কাঠামোকে শক্তিশালী করবে। মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে এই সেবা।

দেশে প্রচলিত ধারার ব্যাংক আছে ৬১টি। এর মধ্যে ১০ ব্যাংকের জোট ‘ডিজি টেন পিএলসি’র নামে লাইসেন্স চেয়েছে। এই জোটে রয়েছে সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ণ ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক।

সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব বিবেচনায় আমাদের আবেদনটি শক্তিশালী। এই ১০ ব্যাংকের সম্মিলিত গ্রাহক ৫ কোটির মতো। আবার শাখা, এটিএম বুথ, পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস), উপশাখা এক লাখের বেশি।’  
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা কোম্পানি উপায়ের নেতৃত্বে একটি জোটের আবেদনও রয়েছে বিবেচনায়, যার নাম ‘উপায় ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি’। এই জোটে আছে বেসরকারি ব্যাংক এনআরবিসি ও মেঘনা। সঙ্গে রয়েছে ইউসিবির উদ্যোক্তাদের কোম্পানি আরামিট ও নাভানা ফার্মা। এ ছাড়া আছে জেনেক্স ইনফোসিস।

আরও পড়ুন

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, এসব প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পেলে ভালো মানের ডিজিটাল ব্যাংক গড়ে উঠবে। তবে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে যাদের নাম এসেছে, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ দুটিকে লাইসেন্স দেওয়া হতে পারে। এর বাইরে স্বল্প পরিচিত দুটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হতে পারে, যার মালিক সরকারের পদে থাকা ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা।

এর বাইরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংক জোটবদ্ধভাবে ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স চেয়েছে। আবেদন করেছে মোবাইলফোন অপারেটর বাংলালিংক ও তাদের মূল কোম্পানি ভিওন। এ ছাড়া ডিজিটাল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান পাঠাও ডিজিটাল ব্যাংক পেতে আবেদন করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, লাইসেন্স দেওয়ার দায়িত্ব পরিচালনা পর্ষদের হলেও লাইসেন্স পায় মূলত সরকারের তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না। সরকারের পক্ষে গভর্নর এই তালিকা উপস্থাপন করবেন। ফলে সরকারের তালিকায় থাকা ব্যক্তিদেরই লাইসেন্স দেওয়া হবে।

ডিজিটাল ব্যাংক কী

ডিজিটাল ব্যাংক পরিচালনার জন্য শুধু প্রধান কার্যালয় থাকবে। সেবা প্রদানে এই ব্যাংকের আর কোনো স্থাপনা, ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি), শাখা বা উপশাখা, এটিএম, সিডিএম অথবা সিআরএম থাকবে না। সব সেবাই দেওয়া হবে অ্যাপনির্ভর, মুঠোফোন বা ডিজিটাল যন্ত্রে।

সেবা মিলবে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা। ডিজিটাল ব্যাংক ভার্চ্যুয়াল কার্ড, কিউআর কোড ও অন্য কোনো উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক পণ্য চালু করতে পারবে। কোনো প্লাস্টিক কার্ড দিতে পারবে না। এ ব্যাংকের গ্রাহকেরা অবশ্য অন্য ব্যাংকের এটিএম, এজেন্টসহ নানা সেবা ব্যবহার করতে পারবেন। এটি ঋণপত্রও (এলসি) খুলতে পারবে না। শুধু ছোট ঋণ দেবে, বড় ও মাঝারি শিল্পে ঋণ দেওয়া যাবে না। তবে আমানত নিতে কোনো বাধা নেই।  

আরও পড়ুন

একেকটি ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের জন্য ন্যূনতম মূলধন লাগছে ১২৫ কোটি টাকা, যা প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৫০০ কোটি টাকা। নীতিমালায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনে উদ্যোক্তাদের অর্ধেককে হতে হবে প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং, উদীয়মান প্রযুক্তি, সাইবার আইন ও বিধিবিধান বিষয়ে শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।

বাকি অর্ধেককে হতে হবে ব্যাংকিং, ই-কমার্স এবং ব্যাংকিং আইন ও বিধিবিধান বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। ডিজিটাল ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) ব্যাংকিং পেশায় কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থনীতিতে এখন নানা সংকট চলছে। এর মধ্যে ডিজিটাল ব্যাংক চালু করলে তা খুব সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। সময়ের প্রয়োজনে নতুন প্রযুক্তিতে আমাদের যেতে হবে। তবে এমন কাউকে এই ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া যাবে না, যাদের অভিজ্ঞতা নেই। এতে সংকট বাড়বে। নতুন করে কোনো সংকট তৈরি করা যাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দক্ষতা বাড়াতে হবে। সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।’