প্রিমিয়ার ব্যাংক ছেড়ে আবার কেন ফিরলেন নতুন চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান
আরিফুর রহমান পেশায় চিকিৎসক। জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে সৌদি আরবে। সৌদি রাজপরিবারের চিকিৎসকও ছিলেন। প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন ভাইস চেয়ারম্যানও ছিলেন। গত ১৯ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁর নেতৃত্বাধীন একটি দলকে এ ব্যাংকে নিয়োগ দেয়।
২১ আগস্ট নতুন পরিচালকেরা আরিফুর রহমানকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করেন। মাঝখানে তিনি জড়িত ছিলেন জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে। জনশক্তি রপ্তানির আয় দিয়েই প্রিমিয়ার ব্যাংকের বড় শেয়ার কিনেছিলেন। কিন্তু শুরুর দিকেই ব্যাংকের কিছু অনিয়ম তাঁর চোখে পড়েছিল।
৩০ আগস্ট আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইচ বি এম ইকবাল শুরুর দিকেই পাঁয়তারা করছিলেন যে এত টাকা বিনিয়োগ করা হলো, এগুলো তো তুলতে হবে। তাঁর বদ-মতলব জেনে গেলে তৎকালীন সময়ের ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সতর্ক করে দিই। এমডি আবার তা জানিয়ে দেন ইকবালকে। তখন থেকেই ইকবালের চিন্তা, আমাকে কীভাবে ব্যাংকের পর্ষদ থেকে সরানো যায়। পরে পরিচালনা পর্ষদ থেকে আমি নিজেই সরে যাই। সৌদি আরবে থাকার কারণে আমার ভাই আমিনুল ইসলাম ছিলেন বিকল্প পরিচালক। তাঁর কাছ থেকে ব্যাংকের সব খবর, বিশেষ করে চেয়ারম্যান এইচ বি এম ইকবালের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের খবর পেতাম।’
প্রবাসজীবন
কথা বলতে বলতে আরিফুর রহমান নিজের চিকিৎসক জীবনের প্রসঙ্গ তোলেন। বলেন, তিনি কর্মরত ছিলেন সৌদি আরবের ন্যাশনাল গার্ড মেডিকেল সার্ভিসেসে। ক্লিনিক ছিল সৌদি আরবের দাম্মাম ও আল খোবার শহরের মাঝখানে। পাশেই একটি ক্যান্টনমেন্ট। সৌদি রাজপরিবার থেকে শুরু করে দেশটির প্রতিরক্ষাবাহিনী ও অভিজাত শ্রেণির লোকেরা ছিলেন রোগী।
এ প্রসঙ্গে আরিফুর রহমান বলেন, একদিন আমার ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে এলেন আল খোদারি নামের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। ঠিকাদারি ব্যবসাও করতেন তিনি। সৌদি সরকার থেকে দাম্মাম শহরকে পরিচ্ছন্ন করার কাজ পেয়েছেন। আমাকে জানালেন, বাংলাদেশ থেকে তাঁর ২ হাজার ৭০০ জন লোক দরকার, আমি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি কি না। সরাসরি ‘না’ বলে দিলাম।
আরিফুর রহমান আরও বলেন, ‘সৌদি আরবের আরেক শহর আল খোবারে ছিলেন বাংলাদেশি আরেক চিকিৎসক সাইদুর রহমান। তিনি ফোন করে জানালেন, রিয়াজুল ইসলাম নামের তাঁর সম্পর্কে এক জামাই এসেছেন ঢাকা থেকে। তাঁকে যেন আল গোসাইরি নামক হোটেলে দিই। আমি রাজি হই। গাড়িতে যেতে যেতে রিয়াজুল আমাকে বললেন, তিনি এসেছেন দাম্মাম শহরের পরিচ্ছন্ন করার কাজ যিনি পেয়েছেন, সেই আল খোদারির সঙ্গে দেখা করতে। পরদিন আমি এ যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিই। ২ হাজার ৭০০ লোক বাংলাদেশ থেকে নেওয়ার কাজটা আল খোদারি পরে ভাগ করে দেন কয়েকজনকে।’
এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর আরিফুর রহমানের কাছে একে একে এসে হাজির হন ব্যবসায়ী আলী আসগর লবি, নূর আলী, এইচ বি এম ইকবাল, আ হ ম মুস্তফা কামাল, এম এ এইচ সেলিম প্রমুখ। এবার এল চার হাজার লোক নেওয়ার কাজ। এটাও কয়েকজন ভাগ করে নিলেন।
অভিযোগ ও আটক
এর মধ্যে পাকিস্তানি কয়েকজন আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করেন যে একজন চিকিৎসক হয়েও বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে জড়িত আরিফুর রহমান। এসব কথা এ প্রতিবেদককে জানান আরিফুর রহমান। এটি ছিল ইকামার নিয়ম ভঙ্গ করা, যা আরিফুর রহমানের জানা ছিল না।
এ অভিযোগের জেরে সৌদি পুলিশ ধরে নিয়ে যায় আরিফুর রহমানকে এবং সন্দেহভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তবে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় প্রায় তিন মাস পর ছেড়ে দেয়। আবার চাকরিতে যোগ দেন আরিফুর রহমান। ইতিমধ্যে এ ঘটনা পৌঁছে যায় সৌদি রাজপরিবারে। সৌদি রাজপুত্র মিশারি বিন সৌদ বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ তখন ন্যাশনাল গার্ডপ্রধান। একদিন আরিফুর রহমানকে ডেকে পাঠালেন। কিছু না লুকিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলেন আরিফুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে লোক এনে দেওয়ার কাজে সহযোগিতা করে যে টাকা আয় হয়েছে, তা–ও জানালাম এবং বললাম, পুরো আয় আমি ফেরত দিতে চাই। মিশারি বিন সৌদ বিন আবদুল আজিজ উল্টো বিস্মিত করে দিয়ে বললেন, তিনি একজন শিক্ষিত ও সৎ মানুষ খুঁজছেন এবং আমি যেন তাঁর বড় ভাই মিশাল বিন সৌদ বিন আবদুল আজিজ আল সাউদের রিক্রুটিং ম্যানেজার হিসেবে ব্যবসা চালাই। রাজপুত্রকে সব সত্যি বলায় আমাকে তাঁর পছন্দ হয়েছে। শুরু করি ব্যবসা।’
ভারত, পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডের ভাগ কেটে নিয়ে সৌদি আরবের নীতি সহায়তায় বাংলাদেশের ভিসা বের করতে থাকেন প্রিমিয়ার ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান। এভাবে চলে ২০১০ সাল পর্যন্ত। আরিফুর রহমান বলেন, ‘তৎকালীন অন্য জনশক্তিকারকদের সহযোগিতা ও নিজে এককভাবে মিলিয়ে বাংলাদেশ থেকে তত দিনে প্রায় ১৭ লাখ বাংলাদেশি চাকরি পেয়েছে সৌদি আরবে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ২০০৪ সালে একটি প্রতিবেদন করে, যেখানে বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ লোক পাঠানোর ক্ষেত্রে আমার অবদানের কথা তুলে ধরা হয়। পরে এ সংখ্যা আরও দুই লাখ বেড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার প্রথম ব্যবসায়িক কফিল রাজপুত্র মিশাল বিন সৌদ নাজরানের গভর্নর হয়ে গেলে তিনি আমাকে তখনকার ক্রাউন প্রিন্স আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজের পুত্র স্কোয়াড্রন লিডার পাইলট তুর্কি বিন আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা হিসেবে বদলি করে দেন। আর এভাবে সৌদি মূল রাজপরিবারের একজন বিশেষ খাদেম হিসেবে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়।’
আরিফুর রহমান একটা ঘটনার কথা স্মরণ করেন। বলেন, ২০০৭ সালে দেশের উপকূলীয় এলাকায় ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ হয়। অনেক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন। তাঁর সহায়তায় পরে এক সৌদি ধনকুবের বরিশাল অঞ্চলে ১৫ হাজারের মতো ঘর ও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করে দেন।
আরিফুর রহমান বলেন, ‘দলীয় রাজনীতি কখনোই করতেন না তিনি। উপস্থিত বক্তৃতা, আবৃত্তি, বিতর্ক ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। বরিশালের বিএম কলেজে ১৯৬৯ সালে ছিলেন সাহিত্য সম্পাদক। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়ও ছিলেন সাহিত্যবিষয়ক কমিটির সদস্য। দল-মতনির্বিশেষে মানুষকে চিকিৎসা করে এসেছি জীবনভর। কেউ কেউ গুজব ছড়িয়েছেন যে চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য আমি ৩০ কোটি টাকা খরচ করেছি। গুজবকারীদের জন্য মায়া হয়। কাদের হয়ে কারা এসব ছড়াচ্ছে, বুঝতে পারি। আমি চাই, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, সিআইডি, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারের সংস্থাগুলো এ নিয়ে তদন্ত করুক।’
যেভাবে ফিরলেন
প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার কারণ তুলে ধরে আরিফুর রহমান বলেন, ‘ব্যাংকটির অনেক ক্ষতি করেছে ইকবাল পরিবার ও তাঁর স্বজনেরা। জুলাই আন্দোলনের পরও তাঁরা অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। সম্প্রতি দুই দফা সাক্ষাৎকার নিয়ে আমাকে এ ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠি পাই। ২১ আগস্ট ৩১৪তম পর্ষদ বৈঠকে উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার হিসেবে আমাকে নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। এসে কী দেখলাম? শুধু একটা সূচকের কথা বলতে পারি। এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২৩ শতাংশের কাছাকাছি এবং এবারই লভ্যাংশ দেওয়া গেল না।’
কৌশলগত কারণে কারও নাম উল্লেখ না করে আরিফুর রহমান জানান, বড় কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীর কাছে তিন হাজার কোটির বেশি টাকা আটকে রয়েছে। এ টাকাসহ সব টাকা উদ্ধারে মনোযোগ দিয়েছেন। নতুন পর্ষদের প্রায় সবাই পেশাদার ব্যাংকার। প্রতিদিন লম্বা বৈঠক করছেন। আমানত ও ঋণ বৃদ্ধির জন্য নতুন পথ বের করছেন।’
কী পথ বের করছেন, তা জানতে চাইলে আরিফুর রহমান বলেন, ‘ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় “থ্রি সি”কে মাথায় রাখতে চাই। থ্রি সি হচ্ছে কনজিউমার, করপোরেট ও কনজারভেটিভ। আগ্রাসী ব্যাংকিং আর নয়। দুই যুগের বেশি সময়ে এ ব্যাংকে অনেক কিছু হয়েছে। চাই নতুন আঙ্গিকে ব্যাংকটিকে দাঁড় করাতে। আমাদের দর্শন হচ্ছে নির্লোভ আমানতদারি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সঙ্গে থাকায় এ ব্যাংক, ব্যাংকের আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের প্রতি একটা দায়িত্ব অনুভব করি। ব্যাংকটার একটা সুন্দর অবস্থান তৈরি করাই হবে আমাদের মূল কাজ।’