বাংলাদেশ ব্যাংকের টেকসই রেটিং তালিকায় আসার অন্যতম কারণ টেকসই অর্থায়ন সূচক। এই খাতে আপনাদের ব্যাংক কেমন অর্থায়ন করেছে। এসব ঋণ কোন কোন খাতে গেছে?
মাসরুর আরেফিন: ২০২২ সালে সিটি ব্যাংক পরিবেশ ও জলবায়ুবান্ধব বিভিন্ন প্রকল্পে ৪৯০ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে। এই অর্থ জ্বালানি ও প্রাকৃতিক সম্পদসাশ্রয়ী, সবুজ কারখানা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শ্রমিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি, অগ্নিনির্বাপণ জোরদার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রভৃতি প্রকল্পে দেওয়া হয়েছে। আমরা ৬ হাজার ১৩২ কোটি টাকা টেকসই কৃষি ও সিএমএসএমই, সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক প্রকল্পসহ অন্যান্য টেকসই প্রকল্পে দিয়েছি। এ ছাড়া গত ২০২১-২২ অর্থবছরে আমরা ৮৪ হাজার ৭৭৪ জন কৃষককে ৫২৬ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছি, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারণ করে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি।
আবার নারীর ক্ষমতায়নের কথা মাথায় রেখে আমরা বেশ আগেই ‘সিটি আলো’ নামে একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। ২০২২ সালের শেষে এসে সিটি আলোর লোন পোর্টফোলিওর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ১২০ কোটি টাকা। নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার বাধা দূর করার লক্ষ্যে ২০২২ সালে আমরা ৪ হাজার ৯৫ জন নারী ব্যবসায়ীকে ৩৮৪ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করেছি। নারী উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের আওতায় প্রায় ২৮০ জন নারীকে আমরা উদ্যোক্তা সনদ দিয়েছি।
এসব ঋণকে কেন টেকসই অর্থায়ন বলা হচ্ছে। অর্থায়ন করা প্রকল্পগুলো কি পরিবেশের ক্ষতি কম করছে?
মাসরুর আরেফিন: টেকসই প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন করলে সেটাকে টেকসই অর্থায়ন বলা হয়। কোনো প্রকল্প টেকসই হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো, পরিবেশদূষণ রোধ করা। টেকসই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে বর্জ্য পানি পরিশোধনাগার (ইটিপি), সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ, রিসাইক্লিং, গ্রিন বিল্ডিং, গ্রিন ফ্যাক্টরি, জ্বালানি ও প্রাকৃতিক সম্পদসাশ্রয়ী প্রকল্প, কৃষি, সিএমএসএমই, নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদান ইত্যাদি। উদাহরণ দিয়ে বললে, ইটিপির কাজ পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে আসা দূষিত পানি পরিশোধন করা। এখন আমরা যখন ইটিপিতে অর্থায়ন করছি, তখন আমাদের অর্থায়নে বানানো ইটিপি নদী, খাল ও বিলকে দূষণের হাত থেকে বাঁচাচ্ছে। আবার আমরা যখন জ্বালানিসাশ্রয়ী মেশিনারিজে অর্থ দিচ্ছি, তার মানে আমাদের ঋণ কার্বন নিঃসরণ কমাচ্ছে।
আপনারা জানেন, সিটি ব্যাংক বাংলাদেশের প্রথম ব্যাংক হিসাবে নেট জিরো ব্যাংকিং অ্যালায়েন্সের সদস্য হয়েছে। নেট জিরো ব্যাংকিং অ্যালায়েন্সে হচ্ছে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক প্রোগ্রামের একটি আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট বড় ইনিশিয়েটিভ। এর আওতায় আমরা আমাদের গ্রাহকদের কার্বন নিঃসরণ পরিমাপ করছি; তাদের কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য যে প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ দরকার, আমরা সেই ঋণও দিচ্ছি। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের রি-ফাইন্যান্স কর্মসূচির আওতায় সহজ শর্তে সবুজ প্রকল্প, সবুজ প্রযুক্তি ও টেকসই প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করছি। তা ছাড়া যেকোনো ঋণ দেওয়ার আগেই আমরা ওই ঋণ সমাজ ও পরিবেশের কী ক্ষতি করতে পারে, তা পর্যালোচনা করে দেখি। বিশ্বব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আইএফসি আমাদের ব্যাংকের বোর্ডে বসে। সিটি ব্যাংকে তাদের বিনিয়োগ করার একটা বড় শর্তই ছিল এটা।
পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে সিটি বাংকের অর্থায়ন কেমন?
মাসরুর আরেফিন: বাংলাদেশ ব্যাংকের সবুজ ও পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের মানদণ্ড অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্পে আমরা ২০২২ সালে ৪৯০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছি। মোটা দাগে এই খাতগুলো হচ্ছে: জ্বালানি ও প্রাকৃতিক সম্পদসাশ্রয়ী প্রকল্প, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সবুজ কারখানা, পরিবেশবান্ধব ভবন, শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা ইত্যাদি। শুধু সিটি ব্যাংকই নয়, আমরা আমাদের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি থেকেও পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে সহায়তা করছি। যেমন আমাদের মার্চেন্ট ব্যাংক সিটি ক্যাপিটাল রিসোর্সেস লিমিটেড থেকে আমরা গ্রিন সুকুক বন্ডে বিনিয়োগ করেছি। ওই অর্থ দিয়ে দুটি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প হবে।
টেকসই কোর ব্যাংকিং সূচকে আপনাদের ব্যাংক কেমন করেছে।
মাসরুর আরেফিন: বাংলাদেশ ব্যাংকের টেকসই ব্যাংক রেটিংয়ে পরপর তিন বছর সিটি ব্যাংকের স্থান পাওয়া প্রমাণ করে যে টেকসই কোর ব্যাংকিং সূচকগুলোতে আমাদের অবস্থান অনেক শক্ত। আমার জানামতে, দেশের মাত্র দুটি ব্যাংকই পরপর তিনবার এই রেটিং পেল। আসল ব্যাংকিং সূচকগুলোয় যেমন ঋণমান, মন্দ ঋণের হার, মূলধন পর্যাপ্ততা, তারল্য, আয় সক্ষমতা, দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক বাড়িয়ে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি—এসবেও আমরা ভালো করে চলেছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টেকসই রেটিং তারই প্রমাণ। পরিবেশ সূচক কিংবা সিএসআর সূচকগুলোর পাশাপাশি মূল ব্যাংকিং সূচকে ভালো করাটা কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের টেকসই ব্যাংক রেটিংয়ে থাকার অন্যতম শর্ত।