নারীর নামে ঋণ নিয়ে খরচ করে পুরুষ

  • নারীদের ৩৭ শতাংশের এমএফএম হিসাব পরিচালনা করেন তাঁদের স্বামী।

  • ৬৩ শতাংশ নারী এমএফএস হিসাবের পাসওয়ার্ড কীভাবে তৈরি করতে হয়, তা জানেন না।

  • ৩৮ শতাংশের বেশি নারীকে ব্যাংকে যাওয়ার জন্য অনুমতি নিতে হয়।

প্রতীকী ছবি

ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো (এমএফআই) দেশের তৃণমূল পর্যায়ের নারীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে দৃশ্যত সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে বেশির ভাগ নারী উদ্যোক্তা তা ব্যবহার করতে পারেন না। ঋণগ্রহীতা নারীদের ৬৬ দশমিক ৩১ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁদের নেওয়া ঋণ স্বামী বা পরিবারের অন্য পুরুষ সদস্যরা ব্যবহার করেন। প্রায় ২৯ শতাংশ নারী নিজেরাই ওই ঋণের টাকা কাজে লাগান। বাকি গ্রহীতাদের ঋণের অর্থ পরিবারের অন্য নারী সদস্যরা ব্যবহার করেন।

নারীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তির এই চিত্র উঠে এসেছে ‘বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে জেন্ডার বৈষম্য’ শীর্ষক এক গবেষণার ফলাফলে। আজ শনিবার ঢাকায় একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি: জেন্ডার প্রেক্ষিত’ শীর্ষক দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিআরডি) এই সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে সহায়তা করে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।

আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে জেন্ডার বৈষম্য নিয়ে গবেষণার একটি অংশ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক। গবেষণার অন্য অংশ তুলে ধরেন আর্থিক অন্তর্ভুক্তিবিষয়ক–বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক লীলা রশিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আয়েশা বানু।

মোট ৫৬টি জেলার ৩ হাজার ৩০০ পরিবারের ৭ হাজার ৫৯১ নারী-পুরুষের মতামতের ভিত্তিতে গবেষণাটি করা হয়। মতামত প্রদানকারীদের মধ্যে সাড়ে ৫৮ শতাংশ বা ৪ হাজার ৪৪২ জন ছিলেন নারী। প্রায় আড়াই বছর ধরে এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়।

গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, ব্যাংক, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবা (এমএফএস) এবং ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান—এই তিন ধরনের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নারীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি হয়। ব্যাংক এবং এমএফএস এই দুটি ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশ পিছিয়ে আছেন। দেখা গেছে, এই দুটি ক্ষেত্রে জেন্ডার গ্যাপ বা পার্থক্য নারীর বিপক্ষে, যথাক্রমে ১৭ দশমিক ২৮ শতাংশ ও ৩৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। তবে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের তুলনায় এগিয়ে আছেন। এখানে জেন্ডার গ্যাপ বরং নারীর পক্ষে, যা ৫৬ শতাংশের বেশি। তবে নারীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে সার্বিক জেন্ডার গ্যাপ ৬ দশমিক ৯ শতাংশ।

আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে নারীরা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন, তা তুলে ধরেন আয়েশা বানু। তিনি জানান, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে নারীরা সাত ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন। এগুলো হলো বিদ্যমান জেন্ডার নীতিমালা ও চর্চা; জেন্ডার সমতার ক্ষেত্রে আদর্শ ও মূল্যবোধকে বাধাগ্রস্ত হওয়া; শিক্ষা, দক্ষতা ও সচেতনতার অভাব; আয় ও সম্পদের ওপর অধিকারের অভাব; তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা পাওয়ায় অসুবিধা; অবকাঠামো উন্নয়নের সুবিধা না পাওয়া এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

আয়েশা বানু বলেন, এজেন্ট ব্যাংকিং পয়েন্ট দুই কিলোমিটার দূরে হলে যাতায়াত ভাড়া ও দূরত্ব—এই দুই বিষয় নারীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করে।

গবেষণার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে লীলা রশিদ জানান, নারী মতামত প্রদানকারীর মধ্যে মাত্র ১১৯ জনের নিজস্ব ব্যবসা আছে। পুরুষদের মধ্যে আছে ৬৮৮ জনের। নারীদের ক্ষেত্রে ৯১ শতাংশের ট্রেড লাইসেন্স নেই। লীলা রশিদের মতে, সার্বিকভাবে নারীর আর্থিক অন্তুর্ভুক্তিকে আলাদা করে বিস্তারিতভাবে দেখা উচিত।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমসের বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড স্নিগ্ধা আলী। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকাররা বোরকা পরা নারীর চেয়ে আধুনিক পোশাকের নারীদের বেশি আস্থায় আনেন। কিন্তু নারীর ঘর থেকে বের হওয়া এখনো নিয়ন্ত্রিত।’

গবেষণার পদ্ধতি তুলে ধরেন সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিআরডি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুখলেসুর রহমান।

সকালে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। তিনি বলেন, এ দেশে যত ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হয়, তার ৯৯ শতাংশ নারীদের মধে৵ বিতরণ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে নানা ধরনের কর্মসূচি নিয়েছে। ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন ঋণ দেওয়া হচ্ছে।

এই অধিবেশনে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমসের ডেপুটি ডিরেক্টর হিলারি মিলার ওয়াইস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আয়েশা বানু।

সংশোধনী: এই প্রতিবেদনে এমএসএফ জেন্ডার গ্যাপ সংক্রান্ত তথ্য সংশোধন করা হয়েছে। এছাড়া, সার্বিক জেন্ডার গ্যাপের তথ্য যোগ করা হয়েছে।