ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের লাইসেন্স কে দেবে, তা এখনো ঠিক হয়নি
খসড়া চূড়ান্ত করতে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন। ১৫ দিনের মধ্যে সেটা চূড়ান্ত করতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংককে লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ করার দাবি খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
পরিশোধিত মূলধনের কাঠামো বদলের প্রস্তাব।
ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক নাকি ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যাংক হবে—আজ এক বৈঠকে এমন প্রশ্ন উঠলে বেশির ভাগই ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যাংকের পক্ষে মত দেন। তবে এ ব্যাংকের লাইসেন্স কে দেবে, তা নিয়ে মত ছিল বিভক্ত। ফলে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেকের সভাপতিত্বে আজ বৃহস্পতিবার ঢাকায় সচিবালয়ে ‘ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়ার ওপর অনুষ্ঠিত বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
খসড়া অনুযায়ী, এ ব্যাংকের লাইসেন্স দেবে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) আওতাধীন একটি আলাদা দপ্তর। তবে ক্ষুদ্রঋণ খাত–সংশ্লিষ্ট শীর্ষ পর্যায়ের অনেকেই চান, বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদান করুক।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় খসড়াটি তৈরি করে দিয়েছিল। এর ওপর উন্মুক্ত মতামত চেয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সেটি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে থাকতেই এ বিষয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি করে যেতে চায় বলে জানা গেছে।
আজকের বৈঠকে এমআরএর নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, বাংলাদেশ পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের, ইনটিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) নির্বাহী পরিচালক জহিরুল আলম, ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরামের (সিডিএফ) চেয়ার মোরশেদ আলম সরকার ও নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন, পল্লী মঙ্গল কর্মসূচির (পিএমকে) জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা এনামুল হক এবং দিশার নির্বাহী পরিচালক রবিউল আলম প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের প্রতিনিধিরা।
গত ১৭ মে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এমআরএ ভবন উদ্বোধনের দিন তরুণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে দেশে ‘ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক’ স্থাপনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক প্রচলিত ধারার ব্যাংকের মতো হবে না। এ ব্যাংক চলবে বিশ্বাস ও আস্থার ওপর ভিত্তি করে, যেখানে ঋণ নিতে জামানত লাগবে না। পাশাপাশি এ ব্যাংকের বড় উদ্দেশ্য হবে, সামাজিক ব্যবসাকে ছড়িয়ে দেওয়া।
ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো যা বলছে
ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে আজ নতুন ব্যাংকের বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে লিখিত মতামত দেওয়া হয়েছে। সেগুলোই বৈঠকে তুলে ধরেন খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সূত্রগুলো জানায়, ক্ষুদ্রঋণ খাত–সংশ্লিষ্টরা শুরুতেই বলেন, ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক নয়, বরং এটি হতে পারে ক্ষুদ্র অর্থায়ন (মাইক্রো ফিন্যান্স) ব্যাংক। আর এ ব্যাংকের লাইসেন্স দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক—এমন মতও দেন তাঁরা। এমআরএর আওতাধীন কোনো দপ্তরকে লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন তাঁরা।
খসড়া অনুযায়ী লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ কোনো একটি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিতে পারবে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছে, এমন সুযোগ রাখা উচিত, যাতে এক বা একাধিক ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান একক বা যৌথভাবে ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে পারে।
খসড়া অনুযায়ী এ ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন হবে ১০০ কোটি টাকা, যার ৬০ শতাংশ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা–শেয়ারমালিকেরা এবং বাকি ৪০ শতাংশ উদ্যোক্তারা দেবেন। এ বিষয়ে নতুন প্রস্তাবে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছে, উদ্যোক্তারা পরিশোধিত মূলধনের ৬০ শতাংশ দেবেন। বাকি ৪০ শতাংশের মধ্যে ২০ শতাংশ ঋণগ্রহীতা বা আমানতকারীরা এবং অবশিষ্ট ২০ শতাংশ অন্যান্য শেয়ারহোল্ডাররা দেবেন।
খসড়ায় ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সাতজন সদস্য রাখার কথা বলা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে তিনজন হবেন ঋণগ্রহীতা–শেয়ারহোল্ডারদের মনোনীত, তিনজন হবেন অন্যান্য শেয়ারহোল্ডারদের মনোনীত এবং পদাধিকারবলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পর্ষদের সদস্য থাকবেন। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, পরিশোধিত মূলধনের হিস্যার অনুপাতে পরিচালক মনোনয়ন হওয়া বাঞ্ছনীয়।
খসড়ায় ঋণগ্রহীতা বা অন্য যেকোনো ব্যক্তির কাছ থেকে আমানত সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ঋণগ্রহীতা বা ব্যক্তি ছাড়াও যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে এর আওতায় আনা যেতে পারে। খসড়ায় ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্র, মালিকানা দলিল বা মূল্যবান সামগ্রী নিরাপদ হেফাজতে রাখার বিধান থাকলেও এ ধারাটি বাদ দেওয়া যেতে পারে।
খসড়ায় ঋণগ্রহীতাদের জন্য আয় সৃষ্টিকারী প্রকল্প গ্রহণের কথা বলা হলেও ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো আয় সৃষ্টি সহায়ক প্রকল্পের কথা অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে।
১০ সদস্যের কমিটি গঠন
বৈঠকে খসড়াটি আরও পরিমার্জনের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সাঈদ কুতুবকে আহ্বায়ক করে গঠিত এ কমিটি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রস্তাবিত খসড়া চূড়ান্ত করবে।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন পিকেএসএফের মহাব্যবস্থাপক নুরুজ্জামান, সিডিএফের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন, আইডিএফের নির্বাহী পরিচালক জহিরুল আলম, এমআরএর নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াকুব হোসেন এবং পিএমকের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা এনামুল হক। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের প্রতিনিধিরা কমিটিতে থাকবেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন উপসচিবও হবেন কমিটির সদস্যসচিব।
এমআরএর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৮৩। এর মধ্যে ব্র্যাক, আশা, ব্যুরো বাংলাদেশ, টিএমএসএস, এসএসএস, সাজেদা ফাউন্ডেশন, উদ্দীপন, জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন, পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন এবং শক্তি ফাউন্ডেশন—এই ১০টি শীর্ষ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান।