দুয়ার নিয়ে জটিলতায় অগ্রণী ব্যাংক

অগ্রণী ব্যাংক

রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এমন অভিযোগ তুলে বলেছে, ব্যাংকটি নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন সফটওয়্যার ব্যবহারের পরিবর্তে তৃতীয় পক্ষের সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। দুয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড নামক একটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন এ সফটওয়্যারের নাম ‘সেলোস্কোপ’। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, প্রতি মাসে দুয়ার সার্ভিসেসকে ১ কোটি ১ লাখ টাকা করে দিচ্ছে অগ্রণী ব্যাংক, যা ব্যাংকের অর্থের অপচয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ৩১ অক্টোবর এসব কথা জানিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মুর্শেদুল কবীরকে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, এজেন্টকে অগ্রণী ব্যাংকের কোর ব্যাংকিং সলিউশনে (সিবিএস) প্রবেশাধিকার দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও অগ্রণী ব্যাংক তা দিয়েছে ‘দুয়ার’কে। এটি ব্যাংকের তথ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

একটা নিরীক্ষার কাজ চলছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসা সুপারিশ অনুযায়ী অগ্রণী ব্যাংক যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।
মো. মুর্শেদুল কবীর, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অগ্রণী ব্যাংক 
আরও পড়ুন

তবে দুয়ারের দাবি, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তারা সঠিক সেবা দিয়ে আসছে এবং যথেষ্ট যুক্তি দেওয়ার পরও তাদের কথা কেউ শুনছে না। বরং অন্যায়ভাবে কয়েক মাস ধরে তাদের পাওনা পরিশোধ করছে না অগ্রণী ব্যাংক।

আট বছর আগে এজেন্ট ব্যাংকিং পরিচালনার অনুমোদনে অগ্রণী ব্যাংককে যে শর্ত দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে দুটি শর্ত ব্যাংকটির এমডিকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে। একটি শর্ত হচ্ছে, এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যাংকের মালিকানাধীন সফটওয়্যারের মাধ্যমে সম্পাদিত হবে, এজেন্ট বা সাব-এজেন্টের সফটওয়্যার ব্যবহার করা যাবে না। অন্য শর্ত হচ্ছে, এজেন্ট বা সাব-এজেন্টের অফিস পরিচালনার ব্যয় অগ্রণী ব্যাংক বহন করতে পারবে না।

অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মো. মুর্শেদুল কবীর সম্প্রতি তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা নিরীক্ষার কাজ চলছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসা সুপারিশ অনুযায়ী ব্যাংক যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।’ এর বাইরে তিনি আর কিছু বলতে চাননি।

অগ্রণী ব্যাংকের যত খরচ

অগ্রণী ব্যাংকের এমডিকে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, সফটওয়্যারের ডেটা সেন্টারের খরচ বাবদ দুয়ারকে মাসে ১ লাখ ৭ হাজার টাকা করে দিয়ে আসছে অগ্রণী ব্যাংক। অথচ এ ডেটা সেন্টার ব্যাংকের ভাড়া করা স্থানে অবস্থিত। এ ছাড়া দুয়ারের স্টেশনারি, আসবাব ও কম্পিউটার সরঞ্জাম অগ্রণী ব্যাংকের অর্থায়নে সরবরাহ করা। কোম্পানিটির ৪০০ কাস্টমার সার্ভিস প্রোভাইডার (সিএসপি) স্থাপনে অগ্রণী ব্যাংক এককালীন ৯০ হাজার করে টাকা দিয়েছে।

ইনফরমেশন টেকনোলজি এনাবল সার্ভিস (আইটিইএস) গ্রাহকসেবার ব্যয় বাবদ সব সিএসপির জন্য অগ্রণী ব্যাংক খরচ করছে এক দফায় মাসে ৫৩ লাখ টাকা, আরেক দফায় ৩৪ লাখ টাকা করে। এ ছাড়া সফটওয়্যার সাপোর্ট বাবদ ব্যাংক ১৩ লাখ টাকা করে দুয়ারকে দিচ্ছে। সিএসপি বেড়ে এখন ৫৫৮টি হওয়ায় খরচ আরও বাড়বে।

দুয়ার সার্ভিসেস লিমিটেডের পরিচালক আসিফ ইউসুফ ১২ নভেম্বর মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান, তিনি শুধু কোম্পানির কারিগরি দিকটি দেখেন। তাই কোনো জবাব দিতে পারছেন না।

পরে কোম্পানিটির অন্যতম উদ্যোক্তা, সবচেয়ে বেশি শেয়ারের মালিক সৈয়দ আহমেদ রসুল ১৪ নভেম্বর প্রথম আলোকে বলেন, দুয়ার আইনকানুন মেনেই ব্যবসা করছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো অনুমাননির্ভর।

কোনো কিছু থেকে থাকলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের। এখানে অন্যায়ের শিকার হচ্ছে দুয়ার। অগ্রণী ব্যাংক বরং কয়েক মাস ধরে দুয়ারের পাওনা পরিশোধ করছে না। এ কারণে বেতন দেওয়া যাচ্ছে না এজেন্টদের।

ব্যাংকের সিবিএসে দুয়ারের প্রবেশাধিকার না থাকা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটিকে দোষারোপ করা হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।

দুয়ার আইনকানুন মেনেই ব্যবসা করছে। অভিযোগগুলো অনুমাননির্ভর। কোনো কিছু থেকে থাকলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের। এখানে অন্যায়ের শিকার হচ্ছে দুয়ার। অগ্রণী ব্যাংক বরং কয়েক মাস ধরে দুয়ারের পাওনা পরিশোধ করছে না।
সৈয়দ আহমেদ রসুল, অন্যতম উদ্যোক্তা, দুয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড

অনুমোদনের আগেই চুক্তি

অগ্রণী ব্যাংক ২০১৫ সালের ২৬ অক্টোবর এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের অনুমোদন পায়। অথচ তার আগে একই বছরের মে মাসে দুয়ারের সঙ্গে ব্যাংকটি চুক্তি করে। যদিও চুক্তিপত্রে তারিখ উল্লেখ নেই। এ ঘটনাকে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নির্দেশনার লঙ্ঘন বলে মনে করে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদনপত্র ব্যাংকের তথ্যপ্রযুক্তি ও ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগ তিন বছর পর্যন্ত গোপন রেখে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এমডি সচিবালয়কে জানায়। আবার ওই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনপত্রের লঙ্ঘন নিয়ে আলোচনা হলেও পর্ষদ কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো বিধিবহির্ভূতভাবে দুয়ারকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অগ্রণী ব্যাংক এ জন্য কিছু খাতের নাম পরিবর্তন করে, যা উইন্ডো ড্রেসিংয়ের শামিল।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের স্থিতিভিত্তিক পরিদর্শন প্রতিবেদনে দুয়ারকে বিধিবহির্ভূত সুবিধা দেওয়ার কথা উল্লেখ করে। পরের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের স্থিতিভিত্তিক পরিদর্শন প্রতিবেদনেও এ বিষয়ে আপত্তি জানায় এবং গত ৬ আগস্টের মধ্যে এমডির ব্যাখ্যা চায়। কিন্তু যথাসময়ে ব্যাখ্যা দেননি অগ্রণী ব্যাংকের এমডি। ৩১ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক তাগাদা দিলে ২০ সেপ্টেম্বর অগ্রণী ব্যাংক জানায়, তারা এ বিষয়ে স্বতন্ত্র নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ডিসেম্বরের মধ্যে নিরীক্ষা

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণের আলোকে দুয়ারের সঙ্গে চুক্তি সংশোধন করতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক সময় দিয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ব্যাংকের স্বার্থবিরোধী চুক্তির মাধ্যমে আগে যে অর্থ দেওয়া হয়েছে দুয়ারকে, তা আদায় এবং এ বিষয়ে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সে বিষয়ে ব্যাংক কোনো বক্তব্য দেয়নি।

আরও বলেছে, নিরীক্ষার জন্য অগ্রণী ব্যাংকের কার্যপরিধিতে দুয়ারকে এযাবৎ খাতওয়ারি কত টাকা দেওয়া হয়েছে, তা নির্ণয়ের কথা বলা নেই। চুক্তির অতিরিক্ত কোনো টাকা দেওয়া হয়েছে কি না, তা-ও যাচাই করার কথা বলা হয়নি। কার্যপরিধিতে তা উল্লেখ করতে হবে।

ব্যাংকের সরাসরি এজেন্ট এবং তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার ব্যয়ের তুলনামূলক পর্যালোচনা বিশ্লেষণও কার্যপরিধিতে রাখতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতিই বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব নির্দেশনা থাকে, সেগুলো মানা উচিত। না মানার অর্থই হচ্ছে শৃঙ্খলার ঘাটতি রয়েছে, যা সার্বিক অর্থে ব্যাংক খাতের জন্য নেতিবাচক। অগ্রণী ব্যাংকের উচিত হবে নিয়মকানুন মেনে চলা। তবে যৌক্তিক জবাব থাকলে ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে পারে।