ব্যাংকের উচ্চ পদে নারী নেতৃত্ব বাড়ছে

নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও ভালো বেতনকাঠামোর ফলে ব্যাংকের চাকরি বেশ সমাদৃত। ফলে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন ব্যাংকে নারীদের অংশগ্রহণ বেশি। এই চাকরি করলে সামাজিক স্বীকৃতিও মেলে। সে জন্য নারীরা ব্যাংকে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। নারীরা শুধু যে ব্যাংকে চাকরিই করছেন, তা নয়, বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে বসে নেতৃত্বও দিচ্ছেন। আবার ব্যাংকের নীতিনির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন অনেক নারী।

তবে মুদ্রার উল্টো পিঠও আছে। সেটি হলো ক্যারিয়ারের মাঝামাঝি সময়ে পুরুষের তুলনায় নারীদের ব্যাংকের চাকরি ছাড়ার হার বেশি। পারিবারিক ও সামাজিক নানা চাপের কারণে তাঁরা ব্যাংক ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জুনের শেষে দেশের ব্যাংক খাতে নারী কর্মীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ হাজার ৫৪৮। ২০২১ সালের একই সময়ে সংখ্যাটি ছিল ২৯ হাজার ৭৭১। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে নারীর কর্মসংস্থান বেড়েছে। বর্তমানে ব্যাংকে নারী কর্মকর্তার হার ১৬ দশমিক ২৮ শতাংশ, যা ২০২১ সালে ছিল ১৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। ব্যাংকে নারীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবেও নারীদের দেখা যাচ্ছে। যেমন বর্তমানে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন হুমায়রা আজম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত ২০২২ সালের জানুয়ারি-জুন সময়ের পরিসংখ্যান বলছে, ব্যাংকে যাঁরা ক্যারিয়ার শুরু করছেন, তাঁদের মধ্যে ১৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ নারী। ব্যবস্থাপনার মধ্যম স্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ১৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আর ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ে যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে ৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ নারী। ২০২১ সালের একই সময়ে ব্যাংকে ক্যারিয়ার শুরু করা নারীর হার ছিল ১৬ দশমিক ২১ শতাংশ। মধ্যম স্তরে ছিল ১৫ দশমিক ৫৯ ও উচ্চপর্যায়ে ৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সেই হিসাবে এক বছরে ব্যাংক খাতে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব বেড়েছে। যদিও বৃদ্ধির হারকে খুব উল্লেখযোগ্য বলা যাবে না।

১০–১৫ বছর আগে এই যাত্রা শুরু হয়। তখন এমন হয়েছে, অনেক নারীকে ডেকে এনে ব্যাংকে বসানো হয়েছে। শুরুতে এটা প্রয়োজন ছিল। না হলে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যে সমানতালে ব্যাংকের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এই পরিস্থিতি দেখা যেত না।
আনিস এ খান, সাবেক চেয়ারম্যান, এবিবি।

শুধু ব্যাংকিংয়ে নয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের অংশগ্রহণ প্রশংসনীয় বলে উল্লেখ করেন আইডিএলসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম জামাল উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারী উদ্যোক্তারা বেশি এগিয়ে। ঋণ যথাসময়ে পরিশোধের ক্ষেত্রেও নারী উদ্যোক্তারা পুরুষ উদ্যোক্তাদের চেয়ে বেশি তৎপর।

ব্র্যাক ব্যাংকের নারী ব্যাংকিং বিভাগের (তারা) প্রধান মেহরুবা রেজা প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকিংয়ে নারীদের অংশগ্রহণ আগের চেয়ে ভালো। দিন দিন নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছেও, তবে সংখ্যাটা আরও বৃদ্ধি পাওয়া উচিত। ব্যাংকে নারীদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব বাড়লেও ক্যারিয়ারের মাঝামাঝি সময়ে তাঁদের মধ্যে পেশা ছেড়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়। মাঝপথে এসে সন্তান-সংসার সামলানোর একটা দোলাচলে পড়ে অনেকে চাকরি ছাড়ছেন। এটা কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। তাহলে ব্যাংক খাতের উচ্চ পদে, মানে নেতৃত্বে আরও নারীকে দেখা যাবে। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে যেমন আন্তরিক হতে হবে, পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদেরও বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।

ব্যাংকে নারীদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব বাড়লেও ক্যারিয়ারের মাঝামাঝি সময়ে তাঁদের মধ্যে পেশা ছেড়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়। মাঝপথে এসে সন্তান-সংসার সামলানোর একটা দোলাচলে পড়ে অনেকে চাকরি ছাড়ছেন। এটা কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে।
মেহরুবা রেজা, নারী ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান, ব্র্যাক ব্যাংক।

২০২২ সালের জুন নাগাদ দেশের ব্যাংক খাতে বোর্ড সদস্য বা পরিচালক হিসেবে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ২০১৮ সালের একই সময়ে এই হার ছিল ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ নীতিনির্ধারণেও নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। সরকারি ব্যাংকগুলোয় নীতিনির্ধারণের জন্য পরিচালক নিয়োগ দেয় সরকার। নারী উদ্যোক্তা, সাবেক নারী ব্যাংকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় মালিকদের স্ত্রী, কন্যা, পুত্রবধূ ও ঘনিষ্ঠজনদের পরিচালক হিসেবে দেখা যায়।

সরকার সম্প্রতি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগসংক্রান্ত নতুন এক নীতিমালা করেছে। সেই নীতিমালায় বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের এক-তৃতীয়াংশই থাকবেন নারী। এ ছাড়া সরকারের শেয়ার রয়েছে, এমন বেসরকারি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এ নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।

সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের পরিচালক দৌলতুন্নাহার খানম প্রথম আলোকে বলেন, এটা শুধু দেশের ব্যাংক খাতের জন্য নয়, সার্বিকভাবে নারীর ক্ষমতায়নের জন্যও ইতিবাচক একটি সিদ্ধান্ত। তবে খেয়াল রাখতে হবে, শুধু কোটা পূরণের জন্যই যেন যে কাউকে বোর্ডে বসানো না হয়। একটু খুঁজলেই ব্যাংক খাতে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো দক্ষ নারী পাওয়া যাবে। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা থাকতে হবে। নারীরা পরিচালনা পর্ষদে বসলে এ খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি কমাতে সহায়ক হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যাংকে নারীদের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় অংশীদার হলো দেশের বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। বর্তমানে ৩১ হাজারের কিছু বেশি নারী ব্যাংক খাতে কর্মরত আছেন। এর মধ্যে ২১ হাজারই কাজ করছেন দেশের বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয়। করোনা সংকট ও পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি কমে এসেছে। সরকারি ব্যাংকের নিয়োগপ্রক্রিয়াও চলছে ধীরগতিতে। তা না হলে পরিস্থিতির আরও পরিবর্তন হতো বলে মনে করেন অনেকে।

এদিকে ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, পড়ালেখা শেষ করে ব্যাংকগুলোয় প্রচুর নারী কর্মী যোগ দেন। কিন্তু পরে তাঁদের একটা অংশ চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। মূলত কাজের চাপ সামলাতে না পারা ও সন্তান লালন-পালনের জন্য ব্যাংকের চাকরি ছাড়েন তাঁরা। তবে অনেক সময় এমনও হয়ে থাকে, পরিবার কিংবা সমাজ থেকে নেতিবাচক মনোভাবের কারণেও নারী ব্যাংকাররা মাঝপথে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। এ ছাড়া অনেক পরিবার ঘরের মেয়ে বা বউকে রাত অবধি কাজ করার অনুমতি দিতে চায় না। তখন চাকরি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সে জন্য উচ্চপর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণ যেভাবে এগোনোর কথা ছিল, ঠিক সেভাবে এগোচ্ছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, নারীদের জন্য দেশের ৬১টি তফসিলি ব্যাংকে ৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি কার্যকর হচ্ছে। এসব ব্যাংকে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নীতিমালা আছে। ৪৭টি ব্যাংক নিয়মিতভাবে লিঙ্গসমতা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে প্রশিক্ষণের আয়োজন করছে। ৩২টি তফসিলি ব্যাংক তাদের কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র স্থাপন করেছে। নারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ৩১টি ব্যাংকের আছে নিজস্ব পরিবহনসুবিধা।

নারী ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিশু দিবাযত্নকেন্দ্রের মতো সুবিধা সব শাখায় সমানভাবে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কয়েকটি ব্যাংকের শাখা নিয়েও এমন ব্যবস্থাপনা থাকতে পারে। এ ছাড়া সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে বাড়ি থেকে কাজ করার সুবিধা ও কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনার ব্যাপারেও অভিমত পাওয়া গেছে। কারণ, ব্যাংকে লম্বা সময় ধরে কাজ করতে গেলে মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়ে।

নারীদের অংশগ্রহণ ব্যাংকিংয়ের বৈচিত্র্য বাড়িয়েছে উল্লেখ করে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, ১০ থেকে ১৫ বছর আগে এই যাত্রা শুরু হয়। তখন এমন হয়েছে, অনেক নারীকে ডেকে এনে ব্যাংকে বসানো হয়েছে। শুরুতে এটা প্রয়োজন ছিল। না হলে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যে সমানতালে ব্যাংকের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এই পরিস্থিতি দেখা যেত না। সমান সুযোগ-সুবিধা ও প্রশিক্ষণ পাওয়ার ফলে সামনের দিনে নারীরা আরও ভালো করবেন।

কয়েকটি ব্যাংকের নারী কর্মীরা জানান, ব্যাংকের পর্যাপ্ত শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র ও যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকলে নারী ব্যাংকারের সংখ্যা আরও বাড়ত। শীর্ষ পর্যায়ের অনেক পদে নারী কর্মকর্তাদের দেখা যেত। পাশাপাশি নারী ব্যাংকারদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ ও পরামর্শের ব্যবস্থা থাকলে নারীরা সহজেই ব্যাংক ছেড়ে যেতেন না। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদকেও উদ্যোগ নিতে হবে।