শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু
ব্যাংক হিসাব জব্দের উদ্যোগ থেকে পেছাল দুদক
পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের বাইরে শেখ আবদুল হাই ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের আরও যেসব সম্পদ রয়েছে, যেগুলো দুদক আদালতকে জানায়নি।
বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুসহ তাঁর পরিবারের পাঁচ সদস্যের তিনটি সম্পত্তি জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এর বাইরে বাচ্চু ও তাঁর পরিবারের আরও সম্পত্তি ও বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সেসব ব্যাংক হিসাব জব্দের সিদ্ধান্ত নিলেও তা আদালতকে জানায়নি। ফলে ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. আছাদুজ্জামান গত বুধবার শুধু তিনটি স্থাবর সম্পত্তি জব্দের আদেশ দিয়েছেন।
২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে শেখ আবদুল হাই বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার দেড় বছরের মাথায় তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের নামে আটটি মাছ ধরার জাহাজ কেনেন। যেগুলোর দাম প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিএম কম্পিউটারস, ইডেন ফিশারিজ, ক্রাউন ফিশারিজসহ তাঁদের মালিকানাধীন আরও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু দুদক এসব তথ্য আদালতকে অবহিত করেনি।
শেখ আবদুল হাইয়ের বিষয়ে শুরু থেকে দুদক যে আনুকূল্যের ভূমিকা পালন করেছে, এ জন্য সংস্থাটিকে আড়চোখে দেখছে মানুষ। এত বছর পর সংস্থাটি এ বিষয়ে কিছুটা উদ্যোগী হলেও তা যথাযথ নয়, বিষয়টা হতাশাজনক।ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
দুদকের তথ্যের ভিত্তিতে আদালত বাচ্চুর যেসব সম্পত্তি জব্দের আদেশ দিয়েছেন, তার মধ্যে রয়েছে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ২২৮ শতাংশ (১৩৮ কাঠা) জমি, ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট বাজার এলাকার ৩০ কাঠা জমি এবং বাচ্চুর একক মালিকানাধীন ঢাকার বনানী ডিওএইচএসের ১ হাজার ৮৫২ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট।
ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ বিচারকের কাছে গত বুধবার বাচ্চু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সম্পত্তি জব্দ ও রিসিভার (তত্ত্বাবধায়ক) নিয়োগের আবেদন করেন দুদকের উপপরিচালক (ডিডি) মোহা. নূরুল হুদা। দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে এ আবেদন করা হয়। একই দিনে আদালত তিনটি স্থাবর সম্পত্তি জব্দের আদেশ দেন।
ডিওএইচএসের ফ্ল্যাট ছাড়া বসুন্ধরা ও ক্যান্টনমেন্ট বাজার এলাকার দুটি জমির মালিকানায় বাচ্চুর পাশাপাশি আরও চারজনের নাম রয়েছে। তাঁরা হলেন বাচ্চুর স্ত্রী শিরিন আক্তার, ছেলে শেখ ছাবিদ হাই, মেয়ে শেখ রাফা হাই ও ভাই শেখ শাহরিয়ার ওরফে পান্না।
দুদকের পিপি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর প্রথম আলোকে বলেন, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে শেখ আবদুল হাই ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলছে। তার অংশ হিসেবে তাঁদের সম্পত্তি জব্দের আবেদন করা হয়। আদালতে শুনানিতে পিপি বলেছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা দেশে নামে-বেনামে যে সম্পত্তি অর্জন করেছেন, সেগুলো বিক্রি করে অর্থ পাচারের চেষ্টা করছেন। এরপর আদেশে আদালত বলেছেন, আদেশ কার্যকর থাকা অবস্থায় জব্দকৃত সম্পত্তি কোনো অবস্থাতেই হস্তান্তর-বিনিময় করা যাবে না।
দুদকের আবেদনে বলা হয়, শেখ আবদুল হাই ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা অবৈধভাবে যে সম্পত্তি অর্জন করেছেন, সেগুলো এখন বেহাত করার চেষ্টা করছেন। অভিযোগ নিষ্পত্তির আগে সম্পত্তিগুলো হস্তান্তর বা স্থানান্তর হয়ে গেলে দুদকের কার্যক্রম ব্যাহত হবে। ক্ষতি হবে রাষ্ট্রেরও। ভবিষ্যতে আরও কোনো স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি এবং ব্যাংক হিসাব অনুসন্ধানে পাওয়া গেলে সেগুলো জব্দের জন্য আদালতে আবেদন করা হবে বলেও জানিয়েছে দুদক।
গত বুধবার আদালতে শেখ আবদুল হাই ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সম্পদ জব্দের আবেদন করলেও সংস্থাটি জব্দের বিষয়ে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেয় ১৩ নভেম্বর। ওই সিদ্ধান্তে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধেরও কথা বলা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আদালতের আবেদনে ব্যাংক হিসাব জব্দের বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে দুদকের পিপি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর প্রথম আলোকে বলেন, এটি দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা ভালো বলতে পারবেন।
আবদুল হাই ও তাঁর পরিবারের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহা. নূরুল হুদা। গত বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে তিনি জানান, এ বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার তাঁর নেই। একই দিন মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে দুদকের সচিব মো. মাহবুব হোসেন ব্যস্ততার কথা বলে এড়িয়ে যান। গত শনিবারও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি।
দুদকের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সম্পত্তির তথ্য চেয়ে তারা সম্প্রতি শেখ আবদুল হাইকে চিঠি দিলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
আদালতে দুদক শেখ আবদুল হাই ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের যে সম্পদের তথ্য জমা দিয়েছে, সেগুলো ‘বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়’ বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়।
২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ১১০ কোটি টাকায় আবদুল হাই ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বাড়ি কেনা নিয়ে প্রথম আলোয় ‘ঘুষের টাকায় বাড়ি কেনেন বাচ্চু ও তাঁর ভাই’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ১২ নভেম্বর প্রকাশিত হয় ‘বসুন্ধরায় ১৩৮ কাঠা জমি শেখ আবদুল হাইয়ের’।
জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, দুদকের পক্ষ থেকে আদালতে তাঁদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের দাবি জানানো উচিত ছিল। দুদক কেন তা করল না, সেটাই বড় প্রশ্ন। শেখ আবদুল হাইয়ের বিষয়ে শুরু থেকে দুদক যে আনুকূল্যের ভূমিকা পালন করেছে, এ জন্য সংস্থাটিকে আড়চোখে দেখছে মানুষ। এত বছর পর সংস্থাটি এ বিষয়ে কিছুটা উদ্যোগী হলেও তা যথাযথ নয়, বিষয়টা হতাশাজনক।