বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন
রাজস্ব ঘাটতি বৃদ্ধির আশঙ্কা
বিশ্বব্যাংক মনে করছে, ক্রমবর্ধমান সরকারি ভর্তুকি ও প্রণোদনার প্রভাব মোকাবিলায় সরকার যে বিনিয়োগ হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা যথেষ্ট নয়।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশও বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়েছে। প্রথম দুটি দেশের মতো বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে জরুরি ঋণের আবেদন করেছে। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে সরকার নানা ধরনের কাটছাঁট করছে।
কিন্তু দেশে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির বড় একটি ক্ষেত্র হচ্ছে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলায় প্রকল্প বাস্তবায়নে যে ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করেছে বাংলাদেশ, তার উল্টো ফল হতে পারে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক মনে করছে, ক্রমবর্ধমান সরকারি ভর্তুকি ও প্রণোদনার প্রভাব মোকাবিলায় সরকার যে বিনিয়োগ হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। এই পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে তারা। তারা বলছে, চলতি অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াতে পারে জিডিপির ৪ দশমিক ৯ শতাংশ, আগের অর্থ বছরে যা ছিল ৪ দশমিক ১ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক অর্থনৈতিক হালনাগাদে এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
শ্রমিকদের এই অভিবাসনের কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি সচল ছিল; এর মধ্য দিয়ে যেখানে মানুষ অধিকতর উৎপাদনশীল হতে পারে, সেখানে যেতে পেরেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে আসায় এবং ‘ব্যালান্স অব পেমেন্টে’ চাপ বাড়তে থাকায় দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের পর তৃতীয় দেশ হিসেবে গত জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে আর্থিক সহায়তার আবেদন করে বাংলাদেশ।
তবে প্রতিবেদনে এ-ও বলা হয়েছে, অন্য দুই দেশের মতো বাংলাদেশের রিজার্ভ বিপজ্জনকভাবে তলানিতে নেমে যায়নি, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাও চলছে না এবং মূল্যস্ফীতির হারও এখনো ১০ শতাংশের নিচেই আছে, যদিও তা সাম্প্রতিক হিসাবে ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছেছে।
ডলারের সাম্প্রতিক চাঙাভাব আর ডলারের বিপরীতে ইউরোর দরপতনে বাংলাদেশ থেকে আমদানি পণ্যে বেশি খরচ করতে হচ্ছে ইউরোপীয় ভোক্তাদের, কারণ দুই পক্ষের বাণিজ্যের লেনদেন ডলারে মীমাংসা হয়ে থাকে এবং স্বল্প মেয়াদে ডলারের দর যথেষ্ট চড়া। ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হলেও বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা এর সুবিধা পাচ্ছেন না।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক রেইজার বলেন, মহামারি, বৈশ্বিক তারল্য ও পণ্যমূল্যে হঠাৎ পরিবর্তন, কিংবা আবহাওয়ার চরম বিপর্যয়—এসব একসময় ঝুঁকির তালিকার শেষ দিকে থাকত। কিন্তু গত দুই বছরে মহামারির ধাক্কার ঠিক পরপরই এই তিন খাতে দ্রুত বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছে।
মাইক রেইজার আরও বলেন, ‘এসব ধাক্কা মোকাবিলার জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোকে মজবুত আর্থিক কাঠামো ও মুদ্রার মজুত গড়তে হবে এবং নিজেদের জনগণের সুরক্ষার পরিসর বৃদ্ধি করতে সীমিত সম্পদের পুনর্বিন্যাস করতে হবে।’
বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য ও জ্বালানি পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও বাণিজ্যে বিধিনিষেধের কারণে এই অঞ্চলের খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি বেড়েছে। তাতে দক্ষিণ এশিয়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়ছে এবং ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর তা ৯ দশমিক ২ শতাংশে উঠতে পারে। তবে এরপর তা কমতে শুরু করবে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়েছে। তবে সবার অবস্থা যে একই রকম, তা নয়। প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, কিছু দেশ এই সংকট অন্যদের তুলনায় ভালোভাবে মোকাবিলা করছে। এ অঞ্চলের বৃহত্তম অর্থনীতি ভারতের রপ্তানি ও পরিষেবা খাতের অত্যন্ত শক্তিশালী পুনরুদ্ধার হচ্ছে, এমনকি তার হার বৈশ্বিক গড়ের চেয়েও বেশি। এ ক্ষেত্রে দেশটির পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাহ্যিক ধকল সামলাতে প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করছে।
অভিবাসনের প্রভাব
প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, কোভিড-১৯ মহামারির সময় মানুষের চলাফেরায় বিধিনিষেধ থাকায় দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসী কর্মীদের মধ্যে যাঁরা অনানুষ্ঠানিক পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, তাঁদের অনেকেই নিদারুণ ক্ষতির শিকার হয়েছেন। অবশ্য মহামারির পরবর্তী পর্যায়ে দেখা গেছে, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে অভিবাসন কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিশ্বব্যাংকের জরিপের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের শেষ ভাগ থেকে ২০২২-এর প্রথম ভাগ পর্যন্ত যে অঞ্চলগুলো মহামারিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সেই সব অঞ্চলের মানুষেরা তুলনামূলক কম ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে অভিবাসন করেন। এর মধ্য দিয়ে শ্রমের চাহিদা ও জোগানের মধ্যের ভারসাম্য এসেছে।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ হান্স টিমার বলেন, শ্রমিকদের এই অভিবাসনের কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি সচল ছিল; এর মধ্য দিয়ে যেখানে মানুষ অধিকতর উৎপাদনশীল হতে পারে, সেখানে যেতে পেরেছে। এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের পক্ষেও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে। সে জন্য এই অঞ্চলের ঘুরে দাঁড়ানো ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে শ্রমিকদের অভিবাসনের পথ নির্বিঘ্ন রাখা জরুরি।