আমানতকারীদের স্বার্থপরিপন্থী কার্যকলাপে অগ্রণীর এমডি

ব্যাংক কর্মকর্তাদের আত্মীয়রা চালাচ্ছেন এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা। বিমানবন্দর বুথেও ধরা পড়েছে নানা অনিয়ম।

অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা পরিচালনায় অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সেবা পরিচালনা করা হচ্ছে দুয়ার সার্ভিসেস লিমিটেডের মাধ্যমে। উদ্বৃত্ত আমানত থাকার পরও এই সেবার মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ করা হচ্ছে, যাতে প্রতি মাসে তিন-চার কোটি খরচ বেড়েছে। আবার ব্যাংকের সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় অবস্থিত এক্সচেঞ্জ হাউসের প্রধান নির্বাহী নিয়োগেও অনিয়ম পাওয়া গেছে। বিমানবন্দরের বুথের পাসপোর্ট এনডোর্সমেন্ট মাশুলও বেশি আদায় করা হয়েছে।

এমন তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বলেছে, এসব অনিয়ম ব্যাংকের এমডির প্রত্যক্ষ মদদ বা প্রশ্রয়ে সংঘটিত হয়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশনা বারবার লঙ্ঘন করে অনিয়মের মাধ্যমে আমানতকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। এসব অনিয়মের বিষয়ে ব্যাংকটির এমডি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বারবার মিথ্যা তথ্য প্রদান করেছেন। সার্বিক বিবেচনায় ব্যাংকের এমডির কার্যক্রম আইনকানুন না মানা (নন–কমপ্লায়েন্ট) এবং তাঁর ভূমিকা আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী মনে হয়েছে।

তবে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এমডি হওয়ার আগে থেকেই এসব চলে আসছে। আর ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তার আত্মীয় এজেন্ট হতে পারবেন না, এটা কোথাও নেই। আর যদি ব্যত্যয় হয়ে থাকে, আমরা তা সংশোধন করব। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ইতিমধ্যে জবাব পাঠানো হয়েছে। আশা করছি, বিষয়টির সমাধান হয়ে যাবে।’

এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা

অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৬৪৩তম সভা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর। এতে ব্যাংকের জন্য ভাড়া করা ভবনটি ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগকে বরাদ্দ প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এই নির্দেশনা লঙ্ঘন করে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মাস্টার এজেন্ট দুয়ার সার্ভিসেস লিমিটেডকে জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এমনকি এই জায়গা বরাদ্দের বিষয়টি দুয়ার সার্ভিসেস ও অগ্রণী ব্যাংকের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, তাতেও উল্লেখ নেই। এরপরও দুয়ার সার্ভিসেসের ব্যবহৃত জায়গার ভাড়া ব্যাংক পরিশোধ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, এটা ব্যাংকের অর্থ তছরুপের শামিল। এ জন্য প্রতি মাসে ২ লাখ ২ হাজার ১৫০ টাকা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা ভাড়া প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছেন এমডি এবং তা এখনো চলছে। ব্যাংকের এমডির ক্ষমতাবহির্ভূত এমন কর্মকাণ্ড আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী।

২০২১ সালের অক্টোবর মাসে অগ্রণী ব্যাংকের অলস তারল্য ছিল ৩০ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। ব্যাংকের আমানত উদ্বৃত্ত ছিল প্রায় ৪৫ শতাংশ। এরপরও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকটি আমানত সংগ্রহ করছে এবং এ খাতে মাসে তিন-চার কোটি টাকা খরচ বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং সেবাবঞ্চিত এলাকায় সেবা পৌঁছে দেওয়া এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার লক্ষ্য। তবে অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা দেওয়া হচ্ছে ঢাকার গুলশান, বনশ্রী, যাত্রাবাড়ী এলাকায়। এসব এলাকায় ১৫টি এজেন্ট নিয়োগ করা হয়েছে। এই ১৫ এজেন্টের মধ্যে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিকট আত্মীয়দের আছে ছয়টি, যার মধ্যে এমডির সহকারী একান্ত সচিবের স্ত্রী ও বোন, বোর্ড ডিভিশনের সচিবের স্ত্রী, বোর্ড ডিভিশনের কর্মকর্তার বোনও আছেন। এই ছয় এজেন্টকে কয়েক বছরে প্রায় ৬ কোটি ২২ লাখ টাকা কমিশন দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক।

সিঙ্গাপুরে পদায়নে অনিয়ম

২০১৩ সালে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৩২২তম সভায় সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় অবস্থিত ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানে প্রেষণে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদায়নের নীতিমালা অনুমোদন হয়। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যাংকটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা শাহ সুজা মো. আবু শরীফকে অগ্রণী এক্সচেঞ্জ হাউস প্রাইভেট লিমিটেড, সিঙ্গাপুরের সিইও হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপরও পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত ছিল, এই পদে নিয়োগের পূর্বে প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা, কম্পিউটার টেস্ট ও মৌখিক পরীক্ষা নিতে হবে। তবে শাহ সুজা মো. আবু শরীফকে নিয়োগের ক্ষেত্রে পরীক্ষাই নেয়নি ব্যাংক। অথচ এই নিয়োগ পরীক্ষায় তিনি ৫০ নম্বরের মধ্যে ৩২ নম্বর পেয়েছেন মর্মে বক্তব্যসহ এমডি পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে একাধিকবার বাংলাদেশ ব্যাংককে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। এই নিয়োগের ক্ষেত্রে এমডি কর্তৃক পরিচালনা পর্ষদের একাধিক সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করা হয়, যা ব্যাংকটির সুশাসনের পরিপন্থী।

বিমানবন্দর বুথে যত অনিয়ম

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্রণী ব্যাংকের এমডি ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে ব্যাংকের বিমানবন্দর বুথের সংস্কারকাজের নামে ৫১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৪২ টাকার বিল অনুমোদন করেন। এই সংস্কারকাজের সপক্ষে ব্যাংক প্রমাণ দিতে পারেনি। এ ছাড়া বিমানবন্দর বুথের ভল্টে ৮ লাখ ৫৬ হাজার ৫৭৫ টাকার তহবিলঘাটতিও পাওয়া যায়। ভল্টে টাকার ঘাটতির মতো সংবেদনশীল বিষয়েও এমডির ভূমিকা ব্যাংকের স্বার্থপরিপন্থী বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বিমানবন্দর বুথের বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রয়ের এনডোর্সমেন্ট মাশুলপ্রতি গ্রাহকের কাছ থেকে ১১০ টাকার পরিবর্তে ১৩০ টাকা আদায় করা হয়। আর এই অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণপ্রক্রিয়ার বৈধতা দিতে ব্যাংকটির এমডি বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন।

এ ছাড়া ম্যাগপাই নিটওয়্যারের এমডির মাধ্যমে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি কানাডায় টাকা পাচার করে বেগম পাড়ায় বাড়ি কিনেছেন, এমন অভিযোগের ব্যাখ্যা চাওয়া হলেও ব্যাংকটি তা দেয়নি বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে।