বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত
দুর্বল পাঁচ ইসলামি ব্যাংক এক করতে প্রশাসক নিয়োগ হচ্ছে
প্রশাসক হবেন নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির পাঁচজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। প্রশাসককে সহায়তা করার জন্য প্রতিটি ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও চারজন করে কর্মকর্তা থাকবেন।
ইসলামি ধারার যে পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোতে প্রশাসক বসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই প্রশাসকেরা একীভূত প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করবেন। প্রশাসক পদে বসানো হবে বাংলাদেশ ব্যাংকেরই পাঁচজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। তাঁদের সহায়তা করার জন্য প্রত্যেক ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও চারজন করে কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে। এর মাধ্যমে পাঁচ ব্যাংক মিলে ইসলামি ধারার একটি ব্যাংক গড়ে উঠবে।
চলতি সপ্তাহের মধ্যে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের আলোকে প্রতিটি ব্যাংকে প্রশাসক দায়িত্ব নেবেন। এরপর তাঁরাই ব্যাংকগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। গতকাল মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। প্রশাসক বসানোর পর নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ। কিছুদিন আগে একীভূত করতে ব্যাংক পাঁচটির শুনানি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে ব্যাংকগুলোর প্রস্তাবে সন্তুষ্ট না হওয়ায় বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করা হয়।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংককে একীভূত করা হবে। নতুন ব্যাংকের সম্ভাব্য নাম ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’। নতুন ব্যাংকের নামে লাইসেন্স ইস্যু করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন সেটির অধীনে চলে যাবে পাঁচ ব্যাংকের সম্পদ ও দায়।
গতকাল পর্ষদ সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান সাংবাদিকদের বলেন, ব্যাংক একীভূত করতে পাঁচ বছর সময় লেগে যাবে। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এখন প্রশাসকেরা এই ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব নেবেন। আগের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা দল বহাল থাকলেও পর্ষদ অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। একীভূত করার প্রক্রিয়া শেষ হলে ব্যাংকগুলোর বর্তমান পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিল হয়ে যাবে।
যেভাবে একীভূত হবে
জানা গেছে, নতুন পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরেও ঘুরে দাঁড়াতে না পারায় ব্যাংক পাঁচটিকে একীভূতের আওতায় আনা হয়েছে। একীভূত প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে শিগগিরই পাঁচ ব্যাংককে ‘নন ভায়াবল বা অকার্যকর’ ঘোষণা করে চিঠি দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে পাঁচ ব্যাংককে জানানো হবে, তারা নিজেরা ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার জন্য সক্ষম না। এরপরই প্রশাসকেরা ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব নেবেন। প্রশাসকেরা শুরুতে ব্যাংকগুলোর যে সম্পদ রয়েছে, তা পুনর্মূল্যায়ন করবেন। পাশাপাশি প্রযুক্তির মাধ্যমে সব ব্যাংকের সম্পদ ও দায় এক করে ফেলার উদ্যোগ নেবেন। জনবল পর্যালোচনা করে ব্যাংকগুলোর মানবসম্পদ বিভাগ একীভূত করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, প্রশাসক হিসেবে নির্বাহী পরিচালক ও জ্যেষ্ঠ পরিচালক পদের কর্মকর্তাদের বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া সনদপ্রাপ্ত আর্থিক বিশ্লেষক, ব্যাংকিং নীতি ও প্রবিধি বিভাগ এবং ব্যাংক পরিদর্শনের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের প্রশাসক দলে রাখা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুসারে, একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রয়োজন ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দেবে ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চাঁদার টাকায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল থেকে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা শেয়ারে রূপান্তরিত করা হবে। বাকি সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা এসব ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকে শেয়ারে রূপান্তর করা হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাতিষ্ঠানিক আমানতের ১০ শতাংশ শেয়ারে রূপান্তরের পরিকল্পনা করেছে বলে জানা গেছে।
ব্যাংক একীভূত করতে পাঁচ বছর সময় লেগে যাবে। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এখন প্রশাসকেরা এই ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব নেবেন। আগের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা দল বহাল থাকলেও পর্ষদ অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। একীভূত করার প্রক্রিয়া শেষ হলে ব্যাংকগুলোর বর্তমান পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিল হয়ে যাবে।
এসব ব্যাংকের মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এক্সিম ব্যাংক ছিল নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে। ব্যাংকগুলো থেকে নামে-বেনামে অর্থ তুলে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
এদিকে পাঁচ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের একীভূতকরণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য আট সদস্যের একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. কবির আহাম্মদকে আহ্বায়ক করে এই কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ রাশেদুল আমিন ও উপসচিব ফরিদ আহমেদ; আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব শেখ ফরিদ ও মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম; বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক রেজল্যুশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ জহির হোসেন এবং একই বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক কাজী আরিফ উজ জামান ও মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন।
পাঁচ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ ব্যাংকের মোট আমানত ধারাবাহিকভাবে কমে গত মে মাসে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকায় নেমেছে, যা গত মার্চে ছিল ১ লাখ ৪৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। আমানত কমার বিপরীত চিত্র রয়েছে ঋণে। সুদসহ নিয়মিতভাবে ঋণের স্থিতি বেড়ে যাচ্ছে। গত মে মাসে এসব ব্যাংকের ঋণস্থিতি কমে হয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা, যা গত মার্চে ছিল ১ লাখ ৯৩ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে পাঁচ ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৭৭ শতাংশ। বিপুল অঙ্কের এ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। শতাংশ বিবেচনায় সর্বোচ্চ ৯৮ শতাংশ ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংকে। এই হার ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৯৬ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামীতে ৬২ শতাংশ ও এক্সিম ব্যাংকে ৪৮ শতাংশ।
এদিকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ধার হিসেবে সর্বোচ্চ সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা নিয়েছে এক্সিম ব্যাংক। এ ছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৭ হাজার ৫০ কোটি, এসআইবিএল ৬ হাজার ৬৭৫ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ২ হাজার ২৯৫ কোটি ও ইউনিয়ন ব্যাংক ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ধার নিয়েছে। এসব ব্যাংকের মধ্যে এক্সিম ব্যাংক ছাড়া বাকি চারটিই গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে সমস্যায় পড়ছে।