২০২৫ সাল হলো দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য সংস্কারের বছর, ছিল অস্থিরতাও। বিশেষ করে ইসলামি ধারার পাঁচ ব্যাংকের আমানতকারীদের জন্য এ বছর কেটেছে চরম অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও ব্যাংকগুলোর পর্ষদ পুনর্গঠন করা হলেও বছর শেষে সাধারণ গ্রাহকেরা টাকা তুলতে পারেননি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে লুটপাটের শিকার হয় এই পাঁচ ব্যাংক। পর্ষদ পরিবর্তন হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, এখন একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর বাইরে বিদায়ী বছরে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে বড় সংস্কার কার্যকর করা হয়নি।
একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংক হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী ও এক্সিম ব্যাংক। এই ব্যাংকের প্রায় ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এই ব্যাংকগুলো তারল্যসংকটের কারণে কর্মীদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছে। গ্রাহকেরাও টাকা তুলে সমস্যায় পড়ছেন। ইতিমধ্যে ‘সম্মিলিত ইসলামি ব্যাংক পিএলসি’ নামে নতুন ব্যাংক গঠনের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকটি সমস্যাগ্রস্ত ওই পাঁচ ইসলামি ব্যাংককে অধিগ্রহণ করবে।
পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে এক্সিম ব্যাংক ছিল ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের। অন্য চারটি ছিল চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের কর্ণধার ও বহুল আলোচিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলমের নিয়ন্ত্রণে। তাঁরা দুজনেই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এসব ব্যাংকে নামে ও বেনামে তাঁদের শেয়ার রয়েছে।
বছরজুড়ে যা ঘটল
চলতি বছরের শুরুর দিক থেকেই এই ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার তীব্র সংকট দেখা দেয়, যা আগে থেকেই চলে আসছিল। অনেক গ্রাহক তাঁদের অতি প্রয়োজনীয় টাকা তুলতে গিয়েও ব্যাংক থেকে খালি হাতে ফিরে এসেছেন। কোনো কোনো শাখায় দিনে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার বেশি দেয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমানত সুরক্ষার আশ্বাস দেওয়া হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট রয়ে গেছে। বিশেষ করে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা এবং নতুন আমানত কমে যাওয়ায় সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।
বছরের শেষ প্রান্তে এসেও ব্যাংকগুলোর রাজধানীর বিভিন্ন শাখায় গ্রাহকদের ভিড় দেখা যাচ্ছে। তবে তা টাকা জমা দেওয়ার জন্য নয়; বরং জমানো টাকা ফেরত পাওয়ার আশায়। অনেক ক্ষুদ্র আমানতকারী এবং পেনশনের টাকা রাখা প্রবীণ ব্যক্তিরা বিপাকে পড়েছেন সবচেয়ে বেশি।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বারবার আশ্বস্ত করেছেন যে কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না এবং গ্রাহকদের টাকা মার যাবে না। তবে ব্যাংকগুলোকে পুনর্গঠন করতে সময় লাগবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি এসব দুর্বল ব্যাংককে তারল্যসহায়তা দেওয়ার জন্য গ্যারান্টি সুবিধা প্রদান করেছে, যা সংকট উত্তরণের একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। একজন আমানতকারীকে তাঁদের ব্যাংক হিসাবে জমা দুই লাখ টাকা পর্যন্ত দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় আমানত বিমা তহবিল থেকে এই টাকা দেওয়া হবে। তবে বছর শেষ হতে চললেও তার দেখা মেলেনি।
দোষীদের শাস্তি নেই
বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকা পাঁচ ইসলামি ব্যাংকের শেয়ার শূন্য করার নির্দেশ দিয়েছে। ব্যাংকগুলোর প্রকৃত সম্পদের মূল্য ঋণাত্মক হয়ে যাওয়ায় ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের আওতায় এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফলে ব্যাংক পাঁচটির পরিশোধিত মূলধন শূন্য হয়ে যাবে। এসব ব্যাংকে থাকা এস আলম, নাসা গ্রুপসহ সব শেয়ারধারীর শেয়ারও শূন্য হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এর মাধ্যমে তাদের শেয়ার শূন্য হয়ে গেলেও ব্যাংকগুলো লুটপাটের জন্য তাদের কারও শাস্তি হয়নি। যদিও ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি মামলা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দ করে ফেরত আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
এদিকে একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকা পাঁচ ব্যাংককে যাঁরা সমস্যায় ফেলেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চায় সরকার। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। চিঠিতে বলা হয়েছে, পাঁচ ব্যাংককে সমস্যায় ফেলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে হবে। সেই সঙ্গে এসব ব্যাংকের সার্বিক অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী মালিক, পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও খেলাপি ঋণ গ্রাহকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। এই পাঁচ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ, বিনিয়োগ ও সম্পদ পুনরুদ্ধারের কথাও চিঠিতে বলা হয়েছে।
কীভাবে টাকা পাবেন গ্রাহকেরা
কী প্রক্রিয়ায় এই টাকা ফেরত দেওয়া হবে ও কারা কারা এই টাকা ফেরত পাবেন, তা নিয়ে একটি স্কিম প্রণয়নের কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। টাকা ফেরতের আগে এই স্কিম প্রকাশ করা হবে। চলতি মাসেই তা প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, যেসব গ্রাহকের হিসাবে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত আছে, তাঁরা চাইলে পুরো টাকা উঠিয়ে নিতে পারবেন। যাঁদের হিসাবে দুই লাখ টাকার বেশি টাকা আছে, তাঁরা তিন মাসে এক লাখ টাকা পাবেন। ওই গ্রাহকের আমানতের বাকি টাকার ওপর মুনাফার হার নতুন করে নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।
নিজেদের টাকা গ্রাহকদের জন্য কিছু শর্ত দেওয়া হবে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো একজন নাগরিকের এক ব্যাংকে একাধিক হিসাব থাকলেও শুধু একটি হিসাবের বিপরীতে টাকা পাবেন। এ জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে তাঁর নামে হিসাব থাকতে হবে। যাঁদের হিসাব বৈধ জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে খোলা হয়েছে, শুধু তাঁরাই টাকা পাবেন। একজন নাগরিকের পাঁচ ব্যাংকের পাঁচটি হিসাব থাকলে প্রতিটির বিপরীতে টাকা পাবেন। সংশ্লিষ্ট আমানতের বিপরীতে ঋণ থাকলে টাকা পাবেন না। ঋণ সমন্বয় করার পর টাকা ফেরতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। বাকি টাকার ওপর সুদের হার নতুন করে নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। এতে খরচ হবে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।
নতুন ব্যাংক কত দূর
রাজধানীর মতিঝিলের সেনাকল্যাণ ভবনে নতুন ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় খোলা হয়েছে। ইতিমধ্যে ব্যাংকটিতে চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ দিয়েছে সরকার। পর্ষদের সবাই সরকারের সাবেক ও বর্তমান আমলা। সামনে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়ে পর্ষদকে আরও যোগ্য করে গড়ে তোলা হবে। টাকা ফেরতের স্কিম ঘোষণার পর একীভূত প্রক্রিয়ায় থাকা শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ইসলামি ব্যাংককে ‘সম্মিলিত ইসলামি ব্যাংক’ হিসেবে নামকরণ করা হবে। এরপর সারা দেশে থাকা পাঁচ ব্যাংকের সব সাইনবোর্ডও বদলে যাবে।
সম্মিলিত ইসলামি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। আর আমানতকারীদের ১৫ হাজার কোটি টাকার আমানত শেয়ারে রূপান্তর করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, নতুন ব্যাংকটিতে স্বতন্ত্র পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কোম্পানি সচিব নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।
সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি মালিকানায় ইসলামি ব্যাংক চালু হওয়া জাতির জন্য সুসংবাদ। ব্যাংকটিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে ইতিমধ্যে কারিগরি দল কাজ করছে। মূল লক্ষ্য হবে, আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা। সম্মিলিত ইসলামি ব্যাংক জাতির আস্থার প্রতীক হয়ে উঠবে।