প্রবাসী আয়ের ডলারের দামে বড় লাফ, কেনা হচ্ছে ১২৩ টাকায়

বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো হঠাৎ করে প্রতি ডলারের দাম ১২-১৩ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাতে অনেক ব্যাংক প্রবাসী আয় কেনা বন্ধ করে দিয়েছে।

মার্কিন ডলার
ছবি: রয়টার্স

সংকটের মধ্যে একলাফে ডলারের দাম ১২-১৩ টাকা বেড়ে গেছে। ডলারের এই মূল্যবৃদ্ধি শুরু হয়েছে প্রবাসী আয় কেনার ক্ষেত্রে। ফলে আমদানি খরচ মেটাতেও ডলারের বাড়তি দাম গুনতে হচ্ছে। বিদেশের রেমিট্যান্স হাউস ও অর্থ স্থানান্তরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি ডলারের জন্য এখন ১২২-১২৩ টাকা পর্যন্ত হাঁকছে। আর দেশের ব্যাংকগুলো তা প্রতিযোগিতা করে কিনছেও। ফলে চলতি মাসের প্রথম চার কার্যদিবসে প্রবাসী আয়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

ব্যাংকগুলোর ঘোষণা অনুযায়ী, আমদানি দায় পরিশোধে ডলারের দাম এখনো ১১১ টাকা। আর প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কেনার ক্ষেত্রে ডলারের ঘোষিত দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। ফলে ব্যাংকগুলোকে এখন ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে ও বিক্রি করতে হচ্ছে। বেশির ভাগ ব্যাংক ডলার কেনা ও বিক্রিতে নথিপত্রে এক দাম ও বাকিটা অন্যভাবে দেখাচ্ছে। এতে ডলারের বাজারে নতুন করে সংকট দেখা দিয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ নিয়ে চলতি সপ্তাহে সভায় বসবে ব্যাংকারদের দুই সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। সেই সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে ডলারের দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে সংগঠন দুটির সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যাংকারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

বিদেশি এক্সচেঞ্জ কোম্পানিগুলো ডলারের দাম ১২২-১২৩ টাকা ৫০ পয়সা চাইছে। এত দামে ডলার কিনে কী দামে কার কাছে বিক্রি করব। তাই ডলার কেনা একরকম বন্ধ করে দিয়েছি।
মাসরুর আরেফিন, ভাইস চেয়ারম্যান, এবিবি

সংকট কেন

দেশে ডলারের মূল জোগান আসে প্রবাসী আয় থেকে। পাশাপাশি রপ্তানি আয় থেকেও ডলার আসে, তবে তার বড় অংশ কাঁচামাল আমদানিতে খরচ হয়ে যায়। এ ছাড়া বিদেশি ঋণ, ঋণসুবিধা, অনুদান, সেবা খাত ও জাতিসংঘে নিযুক্ত শান্তি রক্ষা বাহিনী থেকেও ডলার আসে। আমদানির পাশাপাশি খরচ হয় সেবা খাত, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, বিদেশি বিমানভাড়া, ঋণ পরিশোধসহ আরও নানা খাতে।

গত বছরের মার্চে ইউক্রেনে রাশিয়ায় হামলা শুরুর আগে ডলার যা খরচ হতো, তার চেয়ে বেশি জোগান ছিল। তবে যুদ্ধ শুরুর পর পণ্য ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ডলারের চাহিদাও বেড়ে যায়। শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণ করত। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করছে এবিবি ও বাফেদা।

দাম আসলে কত

এবিবি ও বাফেদা ডলারের যে দাম নির্ধারণ করছে, তা বাস্তবে কার্যকর হচ্ছে খুবই কম। প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কেনায় এখন ডলারের দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। তবে ব্যাংকগুলো এখন ১২২-১২৩ টাকা দামে প্রবাসী আয় কিনছে। যেসব ব্যাংকের আমদানি দায় মেটানোর চাপ আছে, তারা এই দামে ডলার কিনে দায় মেটাচ্ছে। এতে ডলারের দাম এক ধাক্কায় ১২-১৩ টাকা বেড়ে গেছে।

বিদেশের এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, দেশে অর্থ পাঠাতে এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই এখনো ডলারের দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সার মধ্যে রেখেছে। তবে স্মল ওয়ার্ল্ড নামের এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে আয় পাঠালে প্রতি ডলারে মিলছে ১২২ টাকার কিছু বেশি।

নির্বাচনের পর ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তখন দাম সাময়িকভাবে বাড়লেও পরে তা আবার কমে আসবে।
আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই

এটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি, প্রবাসী আয় অধ্যুষিত দেশগুলোতে তারা প্রবাসী আয় সংগ্রহের কাজ করে। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি থাকা শীর্ষ ব্যাংকগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সাউথ বাংলা ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংক। একইভাবে ট্যাপট্যাপ সেন্ড বাংলাদেশে অর্থ পাঠাতে ডলারের দাম ১২২ টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন প্রতি ডলারের দাম দেখাচ্ছে ১১২ টাকা। এর সঙ্গে রয়েছে সরকারের আড়াই শতাংশ প্রণোদনা।

ব্যাংকের প্রবাসী আয় কেনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, সব রেমিট্যান্স হাউস এখন ১২২-১২৩ টাকা দামে ডলার বিক্রির প্রস্তাব দিচ্ছে। কেউ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে, আবার কেউ তা গোপনে করছে। এর বাইরে যাঁদের আয় বিকাশ, রকেটের মতো সেবার মাধ্যমে আসছে, তাঁরা কিছুটা কম দাম পাচ্ছেন।

এবিবির ভাইস চেয়ারম্যান ও সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশি এক্সচেঞ্জ কোম্পানিগুলো ডলারের দাম ১২২-১২৩ টাকা ৫০ পয়সা চাইছে। এত দামে ডলার কিনে কী দামে কার কাছে বিক্রি করব। তাই ডলার কেনা একরকম বন্ধ করে দিয়েছি। হঠাৎ দাম এত কেন বাড়ল, বুঝতে পারছি না। এ নিয়ে করণীয় ঠিক করতে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের পরামর্শ চাইব।’

এদিকে আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রির আনুষ্ঠানিক দাম ১১১ টাকা হলেও তা এখন ১২৩-১২৪ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংক নথিপত্রে ১১১ টাকা উল্লেখ করছে, বাস্তবে নিচ্ছে আরও ১২-১৩ টাকা বেশি।

বাড়ছে প্রবাসী আয়

চলতি ১-৬ নভেম্বর পর্যন্ত প্রবাসী আয় এসেছে ৪৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে আয় এসেছিল ৩৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ফলে এই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। অক্টোবর মাসে প্রবাসীরা বৈধ পথে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে ১৯৭ কোটি ডলার প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন, যা গত চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ ছাড়া এই আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি।

এদিকে ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রি করায় ১০ ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানদের বিরুদ্ধে নেওয়া সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছে ব্যাংকগুলো। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক কর্মকর্তারা নতুন করে আতঙ্কের মধ্যে পড়েছেন। কারণ, আমদানি দায় পরিশোধের জন্য বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে তাঁদের।

দুটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান জানান, যেসব ব্যাংকের বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউস আছে, তারাই বেশি দামে ডলার কিনে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। তারা বিদেশের অন্য এক্সচেঞ্জ হাউস থেকেও বেশি দামে ডলার কিনছে। পাশাপাশি যাঁরা অর্থ পাচার করছেন, তাঁরাও এই চ্যানেল ব্যবহার করছেন। এতে হঠাৎ করে ডলারের দাম বেড়ে গেছে।

এমন পরিস্থিতিতে করণীয় বিষয়ে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন যে পদ্ধতিতে ডলারের দাম নির্ধারণ হচ্ছে, এভাবে নির্বাচন পর্যন্ত চলুক। এটি ধীরে ধীরে বাজারভিত্তিক হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী ডলার কেনাবেচা অব্যাহত রাখুক। এতে রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে। রিজার্ভের ক্ষয় কম হবে। তবে নির্বাচনের পর ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তখন দাম সাময়িকভাবে বাড়লেও পরে তা আবার কমে আসবে।’