দেশেও বাড়ছে নগদবিহীন লেনদেন

রাজধানীর মতিঝিলকে নগদ লেনদেনবিহীন এলাকা গড়ে তুলতে এই ফল বিক্রেতার মতো অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে দেওয়া হয়েছে বাংলা কিউআর কোড
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর মতিঝিল এলাকার পাদুকা মেরামতকারী জয়বাসি ঋষি পাঁচ মাস হলো ডিজিটাল টাকা পরিশোধের মাধ্যম বাংলা কিউআর কোড ব্যবহার করছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে তাঁকে এই কোডভিত্তিক ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমটি খুলে দেওয়া হয়েছে।

এ কোড ব্যবহার করে বর্তমানে তিনি প্রতিদিন গড়ে বিশজনকে সেবা দিয়ে থাকেন। গত বৃহস্পতিবার তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, গ্রাহকদের মধ্যে প্রতিদিন গড়ে কতজন ডিজিটাল বা ক্যাশলেস পদ্ধতিতে টাকা পরিশোধ করেন?

জয়বাসি ঋষি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিন দুই থেকে তিনজন কিউআর কোড ব্যবহার করে বিল পরিশোধ করেন। অন্যরা নগদে অর্থ পরিশোধ করেন। যাঁরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে টাকা পরিশোধ করেন, তাঁরা আগে কৌতূহলবশত কাজটা করতেন। এখন অনেকে নিয়মিত করছেন। তবে অনেকে এখনো এ ধরনের সেবা গ্রহণে সংকোচ বোধ করেন।’

বাংলাদেশ ব্যাংক ছোট ছোট দোকানেও ডিজিটাল লেনদেনের জন্য ব্যবসায়ীদের বিনা পয়সায় হিসাব খুলে দিচ্ছে। পাশাপাশি দোকানে টাঙিয়ে দিচ্ছে বাংলা কিউআর কোড। এই কিউআরে মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান  তো বটেই, ব্যাংকের অ্যাপস ব্যবহার করেও লেনদেন করা যায়। ডিজিটাল লেনদেনে ‘এক কিউআর কোডেই সব অ্যাপস দিয়ে টাকা পরিশোধ’ এই ধারণা থেকেই বাংলা কিউআর কোডের জন্ম।

কার্ড বা বিকাশের মাধ্যমে অনেকেই নগদবিহীন লেনদেনে অভ্যস্ত হলেও বড় বিপণিবিতান বা ব্র্যান্ডের দোকানেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। মতিঝিলের ফুটপাতে ডিজিটাল লেনদেনের এই উদ্যোগ এ বছরই প্রথম নেওয়া হয়েছে। তবে বাংলা কিউআরভিত্তিক লেনদেনের পরিমাণ এখনো তুলনামূলক কম।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ঢাকা ছাড়াও দেশের আরও চারটি জেলা—গাজীপুর, গোপালগঞ্জ, নাটোর ও রংপুরে বাংলা কিউআরের মাধ্যমে ছোট ছোট দোকানে নগদবিহীন লেনদেন হচ্ছে। সব মিলিয়ে দৈনিক এখন তিন হাজারের মতো লেনদেন বাংলা কিউআরে কোডের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা। যার বড় অংশ আসে এমএফএসের মাধ্যমে। আর একটা অংশ আসে ব্যাংক অ্যাপসের মাধ্যমে।

‘আমাদের দোকানে দৈনন্দিন লেনদেনের ৪০ শতাংশের মতো কার্ডে বা কিউআর কোডের মাধ্যমে হয়ে থাকে। বাকি ৬০ শতাংশ এখনো নগদ টাকায় লেনদেন হয়।’
সারাফাত হোসেন, একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রেতা

রাজধানীর অভিজাত বিপণিবিতানগুলোর একটি বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্স। এই বিপণিবিতানে নানা পেশা ও শ্রেণির ক্রেতারা কেনাকাটা করেন। এ বিপণিবিতানের ক্যামেরা জোন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রেতা সারাফাত হোসেন নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দোকানে দৈনন্দিন লেনদেনের ৪০ শতাংশের মতো কার্ডে বা কিউআর কোডের মাধ্যমে হয়ে থাকে। বাকি ৬০ শতাংশ এখনো নগদ টাকায় লেনদেন হয়।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, নগদ টাকার লেনদেন কমাতে এটাই একমাত্র পথ নয়। নগদবিহীন লেনদেনকে জনপ্রিয় করতে আগে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) সুবিধা চালু হয়েছে। রয়েছে ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচের অধীন এটিএম, পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস), কার্ডে লেনদেন ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং ফান্ড ট্রান্সফার-সুবিধা। এ ছাড়া আছে রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্টের সুবিধাও।

ব্যাংকের এসব সেবা ইন্টারনেটভিত্তিক। এ ছাড়া বিকাশ, রকেট, নগদ, উপায়ের মতো মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) মানুষের লেনদেনের অভ্যাসই বদলে দিয়েছে। এমএফএসের কারণে পরিষেবা বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, টিকিট কেনা, শপিং মলে কেনাকাটা, অর্থ স্থানান্তর সেবা—এখন সাধারণ মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।

‘আগামী ২০২৭ সালের মধ্যে দেশের পুরো লেনদেনের ৭৫ শতাংশ নগদবিহীন লেনদেন পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে নগদ টাকার লেনদেন কমে আসবে।’
মেজবাউল হক, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র

মাস্টারকার্ড বাংলাদেশের প্রধান সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নগদবিহীন লেনদেনের কাজটি ধাপে ধাপে করা হচ্ছে। এতে এ ধরনের লেনদেন বাড়ছে। তাই আমরা আশাবাদী। বাংলাদেশ ব্যাংকও নিয়মিত বিষয়গুলো তদারকি করছে। যাতে এই কার্যক্রম আরও ত্বরান্বিত হয়। তবে এ ধরনের উদ্যোগ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে একটা দীর্ঘ সময় লাগে। তত দিন পর্যন্ত এ কাজে লেগে থাকতে হয়।’

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগদ টাকার লেনদেন কমলে টাকা ছাপানো ও ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছর যে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়, তা–ও কমে আসবে। পাশাপাশি প্রতিটি লেনদেনের হিসাব থাকবে। আবার খুচরা টাকার ঝামেলা ও সময়ের অপচয় কমে আসবে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী ২০২৭ সালের মধ্যে দেশের পুরো লেনদেনের ৭৫ শতাংশ নগদবিহীন লেনদেন পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে নগদ টাকার লেনদেন কমে আসবে।’

রাজধানীর মতিঝিলে কিউআর কোড স্ক্যান করে মুচির দোকানে টাকা দেওয়া যাবে
প্রথম আলো

নগদবিহীন লেনদেনের পরিমাণ যেমন

মুঠোফোনের মাধ্যমে এমএফএসে এখন প্রতি মাসে লেনদেন হচ্ছে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি। গত ফেব্রুয়ারিতে এ সুবিধা ব্যবহার করে লেনদেন হয়েছে ৯৭ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারিতে এটিএমে লেনদেন হয়েছে ২৯ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা, পিওএসে ২ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা, ক্যাশ রিসাইক্লিং মেশিনে ৬ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা এবং ই-কমার্সে ১ হাজার ৭১ কোটি টাকা। এ ছাড়া ইন্টারনেটভিত্তিক এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরিত হয়েছে মোট ২৯ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে।

এসব পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাচ্ছে, মানুষ এরই মধ্যে ছাপানো টাকার ব্যবহার ছাড়াই অর্থ লেনদেনে কিছুটা হলেও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তবে পুরো বাংলাদেশকে এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে, গ্রামের মানুষের কাছে এই সেবা আরও সহজলভ্য করতে আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।

ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারি প্রণোদনা ও নীতিসহায়তা পেলে নগদ টাকার ব্যবহার কমবে, আর মানুষ নগদবিহীন বাংলাদেশ ধারণার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।

নগদ টাকার পরিবর্তে ডিজিটাল লেনদেনের ভবিষ্যৎ ভালো উল্লেখ করে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলা কিউআর কোডভিত্তিক লেনদেনের বড় সুবিধা হলো খুচরা টাকা নিয়ে কোনো ঝামেলায় পড়তে হয় না।

তা ছাড়া ডিজিটাল লেনদেনের অন্যান্য মাধ্যম থেকে এই মাধ্যমে লেনদেনে পরিচালন খরচও কম। দেশের লেনদেন পরিষেবার সেটার ইতিবাচক প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে। তবে সাধারণ মানুষকে কোডভিত্তিক লেনদেনে আগ্রহী করতে নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে।