প্রবাসী আয়ে বড় পতন ইউএইতে 

বাংলাদেশের দ্বিতীয় শীর্ষ শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটি থেকে প্রবাসী আয় আসা আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে প্রায় ৪২ শতাংশ কমে গেছে।

দেশে চলমান ডলার–সংকটের মধ্যে দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয় কমেছে প্রায় সাড়ে ২৪ শতাংশ। প্রবাসী আয় কমার দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত বা ইউএই। দেশটি থেকে প্রবাসী আয় আসা এক মাসের ব্যবধানে ৪১.৫০ শতাংশ কমে গেছে। অথচ সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশের দ্বিতীয় শীর্ষ শ্রমবাজার। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্টে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে দেশে প্রবাসী আয় এসেছিল ৩০ কোটি ৪৯ লাখ মার্কিন ডলার। সেপ্টেম্বরে তা কমে নেমে এসেছে প্রায় ১৮ কোটি ডলারে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে দেশটি থেকে প্রবাসী আয় কমেছে প্রায় ১৩ কোটি ডলার বা ৪১.৫০ শতাংশ। বাংলাদেশের দ্বিতীয় শীর্ষ এ শ্রমবাজার থেকে হঠাৎ করে প্রবাসী আয় কমে যাওয়া দুশ্চিন্তার কারণ বলেই মনে করছেন খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

কেন এভাবে দেশটি থেকে হঠাৎ প্রবাসী আয় আসা এতটা কমে গেল, তা খতিয়ে দেখে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, এমডি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক 

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কাজের জন্য যত শ্রমিক বিদেশে গেছেন, তার ১৭ শতাংশই গেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বিএমইটির হিসাবে, ২০১১ থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশটিতে কাজের জন্য গেছেন প্রায় ৭ লাখ শ্রমিক। ১৯৭৬ সাল থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গেছেন  প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক, যা বাংলাদেশ থেকে কাজের জন্য বিদেশ যাওয়া মোট শ্রমিকের ১৭ দশমিক ১৩ শতাংশ।

বিএমইটির হিসাবে, বাংলাদেশের শীর্ষ শ্রমবাজার সৌদি আরব। ১৯৭৬ সাল থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া শ্রমশক্তির ৩৬ শতাংশই গেছে দেশটিতে। সংখ্যার দিক থেকে যা প্রায় ৫২ লাখ। এর মধ্যে ২০১১ সালের পর গেছে প্রায় ২৬ লাখ বাংলাদেশি। এ বাজার থেকেও আগস্টের তুলনায় গত সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয় কমেছে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি ডলার বা ১০ শতাংশ।

ব্যাংক ও জনশক্তি রপ্তানি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, হুন্ডির কারণেই মূলত ইউএই থেকে প্রবাসী আয় এভাবে কম গেছে। সৌদি আরব থেকেও প্রবাসী আয় কমার কারণ মূলত হুন্ডি। এ ছাড়া বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এ দুই দেশেও জীবনযাত্রার খরচ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। ফলে প্রবাসীরা আগের মতো আয় পাঠাতে পারছেন না। 

এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় গত মার্চ-এপ্রিল থেকে ব্যাংক খাতে ডলার–সংকট দেখা দেয়। একপর্যায়ে জুলাই-আগস্টে এসে এই সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ, খোলাবাজারে অভিযান পরিচালনা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রতিদিন ডলার বিক্রি করেও বাংলাদেশ ব্যাংক এ সংকট সামাল দিতে হিমশিম অবস্থায় পড়ে। তারই একপর্যায়ে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় এবং আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণের ভার ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেয়। সেপ্টেম্বর থেকে বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) নেতারা মিলে ডলারের দাম ঠিক করে দিতে শুরু করেন। প্রথম দফায় প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ দাম ঠিক করা হয় ১০৮ টাকা। বলা হয়, কোনো ব্যাংকের এ দামের চেয়ে বেশি দামে প্রবাসী আয় আনতে পারবে না।

ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মূলত দাম বেঁধে দেওয়ার পর থেকে প্রবাসী আয় কমতে শুরু করে। কারণ, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠালে তাতে বেশি লাভ হয় প্রবাসীদের। ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের দামে তিন–চার টাকার ফারাক রয়েছে। তাই হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠালে তাতে বেশি মুনাফা পাওয়া যায়। তা ছাড়া বৈধ পথের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম ঝামেলায় হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানো যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয় প্রেরণকারী শীর্ষ দেশ ছিল সৌদি আরব। দ্বিতীয় স্থানে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, তৃতীয় অবস্থানে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এরপরের অবস্থানে ছিল যথাক্রমে যুক্তরাজ্য, কুয়েত, কাতার, ইতালি ও মালয়েশিয়া। এসব দেশের মধ্যে ইতালি থেকে আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ৩২ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাড়ে ২২ শতাংশ, যুক্তরাজ্য থেকে ২৯ শতাংশ, কুয়েত থেকে ১৮ শতাংশ, কাতার থেকে সাড়ে ১৩ শতাংশ, মালয়েশিয়া থেকে ২৭ শতাংশ প্রবাসী আয় আসা কমে গেছে। 

জানতে চাইলে বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রবাসী আয় আসা প্রায় ৪১.৫০ শতাংশ কমে যাওয়া উদ্বেগের বিষয়। কেন এভাবে দেশটি থেকে হঠাৎ করে প্রবাসী আয় আসা এতটা কমে গেল, তা খতিয়ে দেখে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়লে তাতে অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরবে।

এদিকে সরকার বৈধ পথে প্রবাসী আয় আনতে এখন সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো নিজেরাও বাড়তি প্রণোদনা দিচ্ছে প্রবাসী আয় আনতে। তারপরও প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরে দেশে সব মিলিয়ে প্রবাসী আয় এসেছে ১৫৪ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগস্টের তুলনায় ৫০ কোটি ডলার কম। আগস্টে প্রবাসী আয় এসেছিল ২০৫ কোটি ডলার। আর জুলাইয়ে এ পরিমাণ ছিল প্রায় ২১০ কোটি ডলার।