ছয় ব্যাংকের এমডিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ

বাংলাদেশ ব্যাংক

মার্কিন ডলারের কেনাবেচায় অতিরিক্ত মুনাফা করে বাজার অস্থিতিশীল করার অভিযোগে দেশি-বিদেশি ছয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) কাছ থেকে ব্যাখ্যা তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বুধবার রাতে বাংলাদেশ ব্যাংক এমডিদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে ব্যাখ্যা তলব করেছে। এর আগে এসব ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ব্যাংক ছয়টি হলো দেশীয় মালিকানাধীন ব্র্যাক, দি সিটি, ডাচ্-বাংলা, সাউথইস্ট ও প্রাইম ব্যাংক এবং বিদেশি মালিকানাধীন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান এবং সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন ভাইস চেয়ারম্যান। আর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক হলো দেশের বড় আমদানি দায় শোধের অন্যতম চ্যানেল ব্যাংক।

এর আগে এসব ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার সময় বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, মার্কিন ডলারের বাজার অস্থিতিশীল করে অতিরিক্ত মুনাফা করায় এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এবারের চিঠিতে এমডিদের দায়দায়িত্ব উল্লেখ করে তাঁদের ব্যর্থতার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিদর্শনে পাওয়া গ্রাহকভিত্তিক ডলার কেনাবেচার তথ্য ও ঘোষিত দামের বিষয়টিও চিঠিতে তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছয় এমডিকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কারা দায়ী, তা জানাতে বলা হয়েছে। চিঠির জবাব পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ডলারের বাজার অস্থিতিশীল হলে বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুন মাসে ব্যাংকগুলো পরিদর্শনে গিয়ে ডলার কেনাবেচার তথ্য পর্যালোচনা করে। এতে উঠে আসে, কোনো কোনো ব্যাংক ডলার কেনাবেচা করে এক মাসে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করেছে। যার মাধ্যমে ডলারের বাজারকে আরও অস্থিতিশীল করে তোলা হয় বলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ধরে রেখে সংকট বাড়িয়েছে। সময়মতো দাম সমন্বয় করলে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না। দুর্বল নীতি ও কৌশলের কারণে এখন পুরো দেশের মানুষ ভুগছে। ডলার ও সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে সংকট অনেকটা কেটে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সুনির্দিষ্ট অভিযোগে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তা ভালো। তবে পর্যাপ্ত প্রমাণ সাপেক্ষে শাস্তি দিতে হবে। যদি কোনো অনিয়ম পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ব্যাংকের পর্ষদকেও দায়বদ্ধ করতে হবে।’

ব্যাংকগুলোর এমডিদের কাছে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে, তাতে ডলার কেনাবেচার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এর সারমর্ম হলো, যে দামে এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ের ডলার কেনা হয়েছে, তা ব্যাংকের ঘোষিত দামের চেয়ে অনেক বেশি। আবার আমদানিতে ডলারের যে দাম ধরা হয়েছে, তা-ও ঘোষণার সঙ্গে মিল ছিল না। এর ফলে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে গত মে মাসে বাড়তি মুনাফা হয়েছে। আর মে মাসে ডলার কেনাবেচার যে পার্থক্য (স্প্রেড) ছিল, তা-ও গত বছরের একই সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।

চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পদ দায় ব্যবস্থাপনা নীতিমালা অনুযায়ী, ট্রেজারি বিভাগের রিপোর্টিং প্রধান সরাসরি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তাই কেন ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারা অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে জানতে চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারা অনুযায়ী, ব্যাংকের পরিচালক ও এমডিদের অপসারণ করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে চিঠি পাওয়া ছয় ব্যাংকের এমডিদের কেউ এখনই কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, আমদানি দায় মেটাতে বেশি দামে ডলার কেনা হয়েছে। কারণ, বিদেশি ব্যাংকের দায় সময়মতো শোধ না করলে রেটিং খারাপ হয়ে যায়, ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ জন্য আমদানিকারকদের কাছ থেকেও দাম বেশি নিতে হয়েছে। আবার আগে থেকে ডলার কেনা থাকায় বাড়তি মুনাফা হয়েছে। নিয়ম মেনেই ডলার কেনাবেচা করা হয়েছে। ডলার মজুতের যে সীমা ছিল, তা-ও অতিক্রম করেনি। এখন ডলারের দাম কমে যাওয়ায় লোকসান হচ্ছে। ফলে বছর শেষে এ ব্যবসা থেকে খুব বেশি মুনাফা হবে না। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটি মাসের হিসাবকে বিবেচনায় নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আমদানি খরচ বাড়ায় গত মে মাস থেকে দেশে ডলারের সংকট চলছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে আমদানি দায় শোধ করা যাচ্ছে না। এ কারণে বেড়ে গেছে ডলারের দাম। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম এই সময়ে ৮৬ থেকে বাড়িয়ে ৯৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। পাশাপাশি সংকট সামলাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। তবে ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় আনছে ১০৬ থেকে ১০৭ টাকায়। আমদানিকারকদের কাছে প্রতি ডলারের জন্য ১০৩ থেকে ১০৪ টাকা নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এখন ব্যাংকগুলোর ডলার কেনাবেচায় সর্বোচ্চ ১ টাকা মুনাফা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।