ব্যাংকঋণের সুদের হার আরও বাড়ল 

প্রতীকী ছবি

ব্যাংকঋণের সুদহার বেড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে। গত জুলাইয়ে বেঁধে দেওয়া ৯ শতাংশ সুদহার তুলে নেওয়ার পর এটিই ঋণের সর্বোচ্চ সুদ। গত ফেব্রুয়ারিতেও ব্যাংকে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ ছিল ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। মার্চে তা বেড়ে হচ্ছে ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ। 

ঋণের সুদ নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে এখন প্রতি মাসেই ঋণের সুদ বাড়ছে। তাতে বিপাকে পড়ছেন ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তাসহ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতারা। কারণ, নতুন করে ব্যাংকঋণ নিতে গেলেই গুনতে হচ্ছে বেশি সুদ। এর ফলে ব্যবসার খরচও বেড়ে যাচ্ছে। 

এদিকে ঋণের সুদ বেশি বেড়ে যাওয়ায় সুদহার নির্ধারণ পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল বা স্মার্ট পদ্ধতিতে ঋণের সুদের ভিত্তি হার নির্ধারিত হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় বাড়তি ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ। এ দুইয়ে মিলে ঋণের চূড়ান্ত সুদহার নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলো। মার্চে এসে স্মার্ট হার বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি যুক্ত হওয়া সুদের কিছুটা লাগাম টানা হয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, মার্চে স্মার্ট হারের সঙ্গে বাড়তি যুক্ত হবে সাড়ে ৩ শতাংশ সুদ। আগে যুক্ত হতো ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক এ পরিবর্তন এনেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, নতুন সুদহার কার্যকর হবে শুধু নতুন ঋণের ক্ষেত্রে। পুরোনো ঋণের ক্ষেত্রে সুদহার পরিবর্তিত হবে ছয় মাস পরপর।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ডলার ও গ্যাস-বিদ্যুতের কারণে সব ব্যবসার খরচ বেড়ে গেছে। এখন সুদহার বাড়ানোয় আরও চাপে পড়বেন ব্যবসায়ীরা। তবে শেষ পর্যন্ত সব চাপ গিয়ে পড়বে ভোক্তাদের ওপর। মাঝখানে কিছু ব্যবসায়ী ক্ষতিতে পড়বেন।

এমন পরিস্থিতিতে করণীয় কী তা জানতে চাইলে মাহবুবুল আলম বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্য নিয়ে সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। তবে আগামী জুন পর্যন্ত যাতে আর সুদহার বাড়ানো না হয়। এটাই আমাদের দাবি। কারণ, এত চাপ একসঙ্গে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ 

সুদহার নির্ধারণ যেভাবে 

২০২০ সালের এপ্রিলে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদ ৯ শতাংশে নির্ধারণ করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে অর্থনীতিতে সংকট শুরু হলে গত বছরের জুন থেকে ব্যাংকঋণের সুদহার নির্ধারণে নতুন পদ্ধতি স্মার্ট বা সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল ব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারের ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদহারের ভিত্তিতে ব্যাংকের এ সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে। প্রতি মাসের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক স্মার্ট সুদহার প্রকাশ করে। 

আগে এই স্মার্ট সুদহারের সঙ্গে বাড়তি ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ যুক্ত করে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করতে পারত ব্যাংকগুলো। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গতকালের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, স্মার্ট রেটের সঙ্গে এখন সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদ যুক্ত করতে পারবে ব্যাংকগুলো। প্রাক্-জাহাজীকরণ রপ্তানি ঋণ, কৃষি ও পল্লিঋণের ক্ষেত্রে যুক্ত করতে পারবে সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশ, আগে যা ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

সর্বশেষ গত জানুয়ারির শেষে স্মার্ট রেট বেড়ে হয়েছিল ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই হার আরও বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ, যা মার্চ মাসের জন্য প্রযোজ্য। ফলে ব্যাংকের সুদহার ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ থেকে বেড়ে চলতি মার্চ মাসের জন্য হয়েছে ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ। ব্যাংকের বহুল আলোচিত–সমালোচিত ‘৯-৬ সুদহার’ উঠিয়ে নেওয়ার পর ঋণের সুদহার বেড়ে এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। এ কারণে সুদহার খানিকটা কমানোর উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য মুদ্রানীতি কমিটি কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নীতি সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব স্মার্টের ওপর ইতিমধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ঋণের সুদহার মুদ্রানীতি সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতা বজায় রাখার জন্য ঋণের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে নতুন নির্দেশনা পালন করতে হবে। 

চাপে পড়বে ব্যাংকও 

ব্যাংকগুলোতে এখন ঋণের চেয়ে আমানতের প্রবৃদ্ধি কম। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয় কমিয়ে দিয়েছেন মানুষ। আবার করোনার কারণে দুই বছর ঋণ পরিশোধে ছাড় পাওয়ায় ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ও কমে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে ঋণ দেওয়ার মতো তহবিল কমে এসেছে। আবার শরিয়াভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক তারল্যসংকটে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো টাকা জমা রাখতে পারছে না। কোনো কোনো ব্যাংক এখন আমানত সংগ্রহে ১০ শতাংশের বেশি সুদ দিচ্ছে। তবে বেশি তারল্যসংকটে থাকা কোনো কোনো ব্যাংক ১২ শতাংশ সুদেও আমানত নিচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে সুদহার বাড়ায় তারল্যসংকট আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা। কারণ, ঋণের কিস্তি পরিশোধের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক ঋণগ্রহীতার কিস্তি অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে। 

ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন,‘সুদহার সহনীয় থাকলে ব্যবসায়ীদের জন্য ভালো হয়। কারণ, সুদহার বেড়ে গেলে ব্যবসার খরচ বাড়ে। এতে গ্রাহকের কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যায়। অনেক গ্রাহক ঋণ পরিশোধে বিলম্ব করেন। এমনিতে ঋণ আদায় কমে গেছে। এখন সুদহারের কারণে তা আরও কমতে পারে। তবে আমরা ভালো গ্রাহকদের ক্ষেত্রে নতুন সুদ কার্যকর করছি না। যেখানে ঝুঁকি বেশি, সেখানে বেশি সুদ নিচ্ছি।’