বেসরকারি খাতের যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ের চারজন কর্মকর্তা অভিনব উপায়ে ৯৩ জন গ্রাহকের ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন, এমন অভিযোগ তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।

অভিযোগে বলা হয়, গ্রাহকদের বলা হয়েছিল কোম্পানিতে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রাখলে উচ্চ সুদ পাওয়া যাবে। গ্রাহকেরা সেই আশ্বাসে টাকা রাখেনও। পরবর্তী সময়ে গ্রাহকেরা দেখতে পান তাঁদের অগোচরেই ওই টাকা বিমা পলিসিতে রূপান্তর করা হয়েছে। আবার বিমা পলিসিগুলোও কার্যকর নয়। চট্টগ্রামভিত্তিক এ গ্রাহকদের টাকাগুলো মূলত আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এমন অভিযোগের কথা জানিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে ভুক্তভোগীরা আবেদন করেন গত বছরের আগস্টে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পরামর্শে অভিযোগ আমলে নিয়ে সম্প্রতি ঘটনা তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় আইডিআরএ। সংস্থাটি ৩ মে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যার সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন আইডিআরএর পরিচালক মোহা. আবদুল মজিদ।

তদন্তের অংশ হিসেবে ৯ মে কোম্পানির চট্টগ্রাম সার্ভিস সেন্টারে অভিযোগের সপক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে অভিযোগকারীদের উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করেছে আইডিআরএ।

জীবন বিমা কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের বিমা পলিসি বিক্রি করবে, এটাই নিয়ম। ব্যাংকের মতো মানুষের কাছ থেকে সুদের বিনিময়ে এফডিআর নেওয়ার বিধান নেই জীবন বিমা কোম্পানির। কিন্তু যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি তা মানেনি বলে অভিযোগ।

যাঁদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের একজন যমুনা লাইফের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামরুল হাসান খন্দকার। তিনি আজ শনিবার মোবাইলে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত নন, অর্থ উদ্ধারে জড়িত কয়েকজনের বিরুদ্ধে বরং যমুনা লাইফ মামলা করেছে। দুজন গ্রেপ্তারও হয়েছেন। আইডিআরএর তদন্তকে তিনি সাধুবাদও জানান।

যমুনা লাইফের এ ঘটনা আইডিআরএর নজরে এলে সংস্থাটি গত ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি পরিপত্র জারি করে। আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী স্বাক্ষরিত সেই পরিপত্রে বলা হয়েছে, আইডিআরএর অনুমোদন ছাড়া কোনো কোনো বিমা কোম্পানি গ্রাহকদের কাছে বিমা পরিকল্প (বিমা পণ্য) বাজারজাত করছে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তারা ব্যাংকের মতো মাসিক সুদসহ মাসিক সঞ্চয় কর্মসূচি বা একই ধরনের পণ্য বিক্রি করছে। এতে একদিকে গ্রাহকেরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে কোম্পানির ভবিষ্যৎ দায় বাড়ছে। বিমাশিল্পের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে এতে।

যমুনা লাইফের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান বদরুল আলম খান আজ মোবাইলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কিছু ব্যবস্থা নিয়েছি। আর এটা নিয়ে তদন্ত করছে আইডিআরএ।’ এর বাইরে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিতভাবে কথা বলতে চাননি তিনি।

ব্যাংকের মতো এফডিআর

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ হচ্ছে, এক বছরে ৯ শতাংশ হারে মুনাফা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ৯৩ জন গ্রাহকের কাছ থেকে ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা তুলে নেয় যমুনা লাইফের চক্রটি। পরে টাকাগুলো গ্রাহকদের না জানিয়ে ১৫ থেকে ২১ বছর মেয়াদি বিমা পলিসি করে ফেলে যমুনা লাইফ কর্তৃপক্ষ।

টাকা রেখে প্রতারণার শিকার সরকারি চাকরিজীবী সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ৬ লাখ টাকা রেখেছিলেন যমুনা লাইফে। দুই মাস মুনাফাও পেয়েছেন। হঠাৎ তিনি জানতে পারেন ২১ বছরের জন্য তিনি ছয় লাখ টাকার বিমা পলিসি করেছেন। তাঁর অগোচরেই তাঁকে তানিন ফার্নিচারের ব্যবস্থাপক দেখানো হয়, অথচ তিনি সরকারি চাকরি করেন।

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ৯৩ গ্রাহকের মধ্যে ৫ জনের সঙ্গে কথা বলা হয়। সবার কাছেই একটি প্রশ্ন ছিল যে তাঁরা কেন বিমা কোম্পানিতে এফডিআর করতে গেলেন। সবার জবাব প্রায় একই রকম। সেটি হচ্ছে ২০২০ সালের নভেম্বরে যমুনা লাইফ প্রজ্ঞাপন জারি করে যে ওই কোম্পানিতে এফডিআর করলে ৯ শতাংশ হারে সুদ বা মুনাফা দেওয়া হবে।

চট্টগ্রামের চকরিয়া লক্ষারচর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক বদিউল আলম মোবাইলে প্রথম আলোকে বলেন, যমুনা লাইফ এফডিআর করার সরকারি অনুমোদন পেয়েছে, কোম্পানির তৎকালীন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) মো. জসিম উদ্দিন এবং জ্যেষ্ঠ সহকারী উপব্যবস্থাপনা পরিচালক রবিউল ইসলাম এমন কাগজ দেখালে তিনি ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এফডিআর করেন এবং ব্যাংকের মাধ্যমেই টাকা জমা দেন। পরে জানতে পারেন তা ২১ বছরের পলিসি হয়ে গেছে তাঁর অজান্তেই।

উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে!

জানা গেছে, অর্থ আত্মসাতের জের ধরে এএমডি জসিম উদ্দিন ও জ্যেষ্ঠ সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বরখাস্ত করেছে যমুনা লাইফ কর্তৃপক্ষ। সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী, আতিকুর রহমান ও মিসির রায়হান নামের তিন কর্মকর্তা এক চিঠিতে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের কাছে কীভাবে এ টাকা আত্মসাৎ হয়েছে, তার পুরো প্রক্রিয়া তুলে ধরলে তাঁদেরও পরে বরখাস্ত করা হয়।

সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সিইওর নেতৃত্বে চারজনের মাধ্যমে মূলত এ অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে। একই কথা বলেন আতিকুর রহমানও। তিনি বলেন, ‘কোম্পানির পর্ষদকে এ ঘটনা জানানোর পরও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, বরং উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে ঠেলে দিয়ে আমাদের তিনজনকে বরখাস্ত করেছে।’

তবে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের মধ্যে কোম্পানির চট্টগ্রাম কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরীও রয়েছেন। এ ছাড়া ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হিসাব বিভাগের প্রধান মোজাম্মেল হক ওরফে সরমনের নামও এসেছে। মোজাম্মেল হক ওরফে সরমনকে বারবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। বিষয়বস্তু উল্লেখ করে খুদে বার্তা দিলেও জবাব দেননি তিনি।

অন্যদিকে মো. জসিম উদ্দিনের সঙ্গে আজ মোবাইলে যোগাযোগ করে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ব্যস্ত আছেন, কথা বলতে পারবেন না। কখন কথা বলবেন, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি দ্রুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি। রবিউল ইসলামের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করলে তিনিও কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।

সার্বিক পরিস্থিতির কথা জানালে আইডিআরএর সাবেক চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারী আজ প্রথম আলোকে বলেন, কোনো বিমা কোম্পানিই এফডিআর নিতে পারে না। বিমা খাতের ভাবমূর্তি বজায় রাখার স্বার্থেই জালিয়াত চক্রটিকে চিহ্নিত করে যথাযথ শাস্তির আওতায় আনা এখন জরুরি।