ন্যাশনাল ব্যাংকের ৫০ কোটি টাকা গচ্চা

ব্যাংকটির বিনিয়োগ করা ৫০ কোটি টাকা ছাড়া আরও চার তহবিলের ১৫৮ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান ইউএফএস।

ন্যাশনাল ব্যাংক

নানা তদবির করে গত বছরে দুই মিউচুয়াল ফান্ডে ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের অনুমতি নিয়েছিল বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির ঋণ প্রদান কার্যক্রম খুলে দেওয়ার পর এই বিনিয়োগের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এরপর ন্যাশনাল ব্যাংক দুই দফায় ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগও করে দুটি মিউচুয়াল ফান্ডে। তহবিল দুটির সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সাল ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশনসকে (ইউএফএস) খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে ১৫৮ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার। ফলে ন্যাশনাল ব্যাংকও তাদের বিনিয়োগের ৫০ কোটি টাকা গচ্চা গেছে বলে ধরে নিয়েছে।

বিশেষ উদ্দেশ্যে গঠিত তহবিল ও বিকল্প বিনিয়োগ তহবিলে ব্যাংকের বিনিয়োগের জন্য ২০১৫ সালে নীতিমালা করে এই বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আওতায় ন্যাশনাল ব্যাংক এ বিনিয়োগ করে।

তদন্ত শেষে প্রকৃত তথ্য জানা যাবে। কীভাবে এ ঘটনা ঘটল এবং কার দায় কতখানি ইত্যাদি বিষয় তদন্তে উঠে আসবে বলে আশা করছি। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মোহাম্মদ রেজাউল করিম নির্বাহী পরিচালক, বিএসইসি

দুই দফায় নাকচ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংকের চিঠি চালাচালির নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২১ সাল থেকে ইউএফএসইপিএল ইকুইটি ফান্ডে ১০০ কোটি টাকা ও ইউএফএসইপিএল ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। এরপর ব্যাংকটির এই বিনিয়োগের অনুমোদন নেওয়ার চেষ্টা শুরু করে।

তারই অংশ হিসেবে ২০২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠি দিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) জানায়, ব্যাংকের সার্বিক তারল্য পরিস্থিতি, সম্পদের গুণগত মান এবং ঝুঁকি বিবেচনায় এমন দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ উপযোগী নয়, এ জন্য বিনিয়োগের আবেদন নাকচ করা হলো।

এরপর ব্যাংকটি আবারও বিনিয়োগের অনুমতি চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন করে। ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ব্যাংকটির এমডিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, ২০০ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের আবেদন প্রস্তাব পুনরায় নাকচ করা হলো। এই সময় পর্যন্ত ঋণ অনিয়মের কারণে ব্যাংকটির ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

তালা খুলে অনুমোদন

ব্যাংকের একজন শীর্ষ গ্রাহকের চাপে ২০২১ সালে ৩০ ডিসেম্বর ব্যাংকটির ঋণের তালা খুলে দেওয়া হয়। এরপর গত বছরের ৫ জানুয়ারি ব্যাংকটির এমডি আবারও এই বিনিয়োগের অনুমতি চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করে। এর সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংক আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসির মতামত যুক্ত করে দেয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন শর্ত দিয়ে গত বছরের ১৬ জানুয়ারি দুই তহবিলে ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ১২ মে আবারও ব্যাংকটির ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বিনিয়োগ অনুমতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শর্তের মধ্যে ছিল চারটি সমান কিস্তিতে অর্থ ছাড়, সুনির্দিষ্ট বিনিয়োগের প্রস্তাবের বিপরীতে ১ম কিস্তি ছাড়। ১ম কিস্তির অর্থের যথাযথ ব্যবহারের পর দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়। এরপর আগের কিস্তির যথাযথ ব্যবহারের পর পরের কিস্তি ছাড় করার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ইউএফএসইপিএল ইকুইটি পার্টনার বিও হিসাব খোলে ব্রোকারেজ হাউস এনআরবিসি ব্যাংক সিকিউরিটিজে। বিও হিসাব খোলা হয় ইউএফএসইপিএল প্রাইভেট ইকুইটি ফান্ড ও ইউএফএসইপিএল ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড নামে।

গচ্চা ৫০ কোটি টাকা

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি পেয়েই ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ন্যাশনাল ব্যাংক। এরপর এই দুটির হিসাব বিবরণী সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে ব্যাংকটি তা দিতে পারেনি। তাই গত বছরের ৭ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠি দিয়ে জানায়, ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের অনুমোদন বাতিল করা হলো।

ইতিমধ্যে যেসব অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা ট্রাস্টির মাধ্যমে আদায়ের পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব তথ্য জানাতে হবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি)। তবে ব্যাংকটি এখন টাকাও আদায় করতে পারছে না, খুঁজে পাচ্ছে না সম্পদ ব্যবস্থাপককে।

আরও ১৫৮ কোটি টাকা আত্নসাৎ

ন্যাশনাল ব্যাংকের ৫০ কোটি টাকা ছাড়াও শেয়ারবাজারের চারটি মিউচুয়াল ফান্ডে জমা থাকা প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের প্রায় ১৫৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন শেয়ারবাজারের সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান ইউএফএসের শীর্ষ ব্যক্তিরা। ২০১৮ সাল থেকে একটু একটু করে বিভিন্ন তহবিল থেকে অর্থ সরিয়ে নেন ইউএফএসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হামজা আলমগীর। ভুয়া লেনদেন ও আর্থিক প্রতিবেদনে কারসাজির মাধ্যমে এ আত্মসাতের ঘটনা ঘটানো হয়।

২০১৮ সাল থেকে আত্মসাতের ঘটনা ঘটলেও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নজরে আসে তা গত জুনে। এরপরই বিএসইসি তদন্ত কমিটি গঠন করে। প্রাথমিক তদন্তে এর সত্যতাও খুঁজে পায়।তত দিনে অবশ্য অর্থ আত্মসাৎকারী বিদেশে পালিয়ে গেছেন।

জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে প্রকৃত তথ্য জানা যাবে। কীভাবে এ ঘটনা ঘটল এবং কার দায় কতখানি ইত্যাদি বিষয় তদন্তে উঠে আসবে বলে আশা করছি। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।