ডাক বিভাগের ৮ ডিজি ও নগদের সাবেক চেয়ারম্যান-সিইওসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা

মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’

রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়া অন্য কারও অর্থ ইস্যু করার ক্ষমতা নেই। অথচ মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) নগদ লিমিটেড ব্যাংকে জমা অর্থের অতিরিক্ত ৬৪৫ কোটি টাকার ইলেকট্রনিক মানি অর্থ তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে অর্থনীতি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি অনাকাঙ্ক্ষিত মূল্যস্ফীতিও তৈরি হয়েছে। এমন অভিযোগে ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ মামলায় সরকারের ডাক বিভাগের আটজন সাবেক ও বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি), নগদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে (সিইও) আসামি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক সরকার আমির খসরু বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় মামলাটি করেন (নম্বর ০২)। মামলায় অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক মানি বা ই-মানি তৈরি ও নথিপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে ৬৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।

রাজধানীর মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন প্রথম আলোকে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নগদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে গত সোমবার মামলাটি করা হয়েছে।

ই-মানির যে ঘাটতির কথা বলা হচ্ছে, সেটি নগদের প্রশাসক দল তৈরি করেছে। তারা এখন আমাদের ওপর এই দায় চাপানোর চেষ্টা করেছে। আশা করি, খুব তাড়াতাড়ি আমরা এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেব।
—তানভীর আহমেদ মিশুক, সাবেক সিইও, নগদ

মামলার আসামিদের মধ্যে আছেন নগদের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল ও সাবেক সিইও তানভীর এ মিশুক; বিদেশি পরিচালক গিলস অলস্টেয়ার জেমস ফার্লে; পরিচালক শাফায়েত আলম, মারুফুল ইসলাম ঝলক, আমিনুল হক, নিয়াজ মোর্শেদ, ফয়সাল আহসান চৌধুরী, এম তামজিদ রহমান, সৈয়দ আরশাদ রেজা, মিজানুর রহমান, রাহেল আহমেদ ও রেজাউল হোসেন। এ ছাড়া নগদের কর্মকর্তা রাকিবুল ইসলাম, আবু রায়হান ও আশীস চক্রবর্তীকেও আসামি করা হয়েছে।

ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালকদের (ডিজি) মধ্যে সুশান্ত কুমার মন্ডল, সুধাংশু শেখর ভদ্র, বাহিজা আক্তার, সিরাজ উদ্দিন, ফয়জুল আজিম, হারুনুর রশীদ, তরুন কান্তি সিকদারকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমান ডিজি এস এম শাহাব উদ্দিনও আসামি।

মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশ পোস্ট অফিস নগদ নামে পোস্টাল ক্যাশ সেবা চালু করে। পরে নগদের মাধ্যমে মোবাইলে আর্থিক সেবা বিস্তৃতি হতে শুরু করলে ২০১৭ সালে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির সঙ্গে চুক্তি করে পোস্ট অফিস। ২০২০ সালে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি নাম পরিবর্তন করে হয় নগদ লিমিটেড। মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করাই ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য। নগদ আইনের বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত ৬৪৫ কোটি টাকা ইলেকট্রনিক অর্থ ইস্যু করেছে। এতে লেনদেন ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা নষ্ট করা হয়েছে। জমা টাকার চেয়ে বেশি অর্থ তৈরি করায় গ্রাহকের দাবি পুরোপুরি নিষ্পন্ন করতে পারবে না নগদ। এ জন্য আসামিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার নগদে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। প্রশাসক বসানোর পর নিরীক্ষায় উঠে এসেছে, নগদ লিমিটেডে বড় ধরনের জালিয়াতি হয়েছে। ভুয়া পরিবেশক ও এজেন্ট দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে আর্থিক জালিয়াতি এবং অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক অর্থ বা ই-মানি তৈরি করা হয়েছে। এসব কারণে ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার হিসাব মিলছে না।

সাবেক সরকারের আমলে নিয়মের বাইরে গ্রাহক বানানো, সরকারি ভাতা বিতরণসহ একচেটিয়া সুবিধা পায় নগদ। প্রতিষ্ঠানটিতে যখন এসব অনিয়ম সংঘটিত হয়, তখন এর পরিচালনায় আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি যুক্ত ছিলেন। সবার চোখের সামনে এসব অনিয়ম হলেও চুপ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ডাক অধিদপ্তর।

এ নিয়ে জানতে চাইলে মামলার আসামি ও নগদের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তানভীর আহমেদ মিশুক এক লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘মিথ্যা ও বানোয়াট কিছু তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মামলা দেওয়া হয়েছে। মামলায় বলা হয়, ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি ঘাটতি রয়েছে নগদে। কিন্তু গত নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক চিঠিতে ই-মানির ঘাটতি ৪৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। ই-মানির যে ঘাটতির কথা বলা হচ্ছে, সেটি নগদের প্রশাসক দল তৈরি করেছে। তারা এখন আমাদের ওপর এই দায় চাপানোর চেষ্টা করেছে। আশা করি, খুব তাড়াতাড়ি আমরা এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’