সুশাসনে ঘাটতির কারণেই ব্যাংক খাতের উন্নতি হয়নি

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে এক বছর বড় আকারের অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে তো পরের এক-দুই বছরে বাজেটের মাধ্যমে তাদের প্রায় সেই পরিমাণ অর্থই দিয়েছে সরকার। আবার এই অর্থ দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে, যা একেবারে জনগণের করের টাকা। বিশেষ করে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৭-১৮ পর্যন্ত ছয় অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে করের টাকা দেওয়াটা ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। এই সময়ে ব্যাংকগুলোকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় সংসদে ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পরদিন বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ব্যাংকগুলোর উন্নতি হচ্ছে। এখন আর রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে কোনো টাকা দেওয়া হচ্ছে না। তবে অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মাথায় মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, মূলধন ঘাটতি পূরণে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে আর বরাদ্দ দেওয়া হবে না। তিনি এ-ও বলেছিলেন, খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না। এ কথা বলার সময় দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৪ হাজার কোটি টাকা। অথচ গত মার্চে তা প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা বেড়ে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকায় উঠেছে।

ব্যাংক খাতে সুশাসনের ঘাটতি নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে ব্যাংক খাতের মূলধন ভিত্তি দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় দুর্বল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদনের বিপরীতে খেলাপি ঋণ বেসরকারি ব্যাংকে ৫ শতাংশের নিচে এবং রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে রাখার শর্ত দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক
ছবি: সংগৃহীত

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গত ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপির কাছ থেকে সোনালী ব্যাংক ৪ শতাংশ, রূপালী ৩ শতাংশ, জনতা ১১ শতাংশ ও অগ্রণী ৩৭ শতাংশ আদায় করেছে। জানা গেছে, শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে সোনালী ব্যাংকের পাওনা ৪ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকটিকে ৩০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছিল। তারা আদায় করেছে মাত্র ১১ কোটি টাকা।

অবলোপন করা ঋণ থেকেও ব্যাংকগুলোর আদায় কম। সোনালী ৬ হাজার ৮২৮ কোটি টাকার মধ্যে ১ হাজার ৭৬ কোটি, জনতা ৩ হাজার ৪১৩ কোটির বিপরীতে ১১২ কোটি, অগ্রণী ৪ হাজার ৪৫ কোটির মধ্যে ৮৮ কোটি এবং রূপালী ৫৯১ কোটির বিপরীতে ১১ কোটি টাকা আদায় করেছে।

ব্যাংকগুলোকে করের টাকা দেওয়া ঠিক আছে। তবে উচিত হচ্ছে, ব্যাংকের খারাপ পরিস্থিতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের যথাযথ বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। এ বিষয়ে আমাদের ঘাটতি আছে।
এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম, উপদেষ্টা, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলধন ঘাটতির জন্য টাকা না দেওয়াসহ ব্যাংক খাত নিয়ে আমি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, সবই রক্ষা করার পথে আছি। খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না বলে যখন কথা বলেছিলাম, তখনকার তুলনায় বর্তমানে ঋণ বিতরণ যত গুণ বেড়েছে, তার সঙ্গে তুলনা করলে খেলাপি ঋণ বাড়েনি, বরং কমেছেই। তবে মোট হিসাবে তা যতটা বেড়েছে, তা-ও বাড়ত না। প্রথমে করোনাভাইরাস ও পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেও এর প্রভাব রয়েছে। ফলে সংগত কারণেই পরিমাণটা বেড়েছে।’

ব্যাংকগুলো কেন পেল করের টাকা

যেসব ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে, সেগুলোকেই জনগণের করের টাকা থেকে মূলধন সরবরাহ করেছে সরকার। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসার পর ১৪ বছরের মধ্যে ৭ বছরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে।

সরকারি যেসব ব্যাংকে অর্থ আত্মসাৎ বেশি হয়েছে, সেগুলোকেই কখনো মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ, কখনো মূলধন ঘাটতি বা প্রভিশন ঘাটতি পূরণ, কখনোবা মূলধন পুনর্ভরণের নামে টাকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ও বেসিক ব্যাংক।

এমনকি বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংককে (বর্তমান নাম পদ্মা ব্যাংক) বাঁচাতেও সরকারি উদ্যোগে দেওয়া হয়েছে ৭০০ কোটি টাকা। বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলেও ব্যাংক বন্ধ হতে দেওয়া হয় না বাংলাদেশে। একইভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও লিজিং কোম্পানির বন্ধ হওয়াও ঠেকিয়ে রাখা হচ্ছে।

খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না বলে যখন কথা বলেছিলাম, তখনকার তুলনায় বর্তমানে ঋণ বিতরণ যত গুণ বেড়েছে, তার সঙ্গে তুলনা করলে খেলাপি ঋণ বাড়েনি, বরং কমেছেই।
আ হ ম মুস্তফা কামাল, অর্থমন্ত্রী।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংক ব্যর্থ হলে অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব পড়ে। এক ব্যাংক ব্যর্থ হলে অন্য ব্যাংক থেকেও মানুষ আমানত উঠিয়ে নেয়। আমানত না থাকলে ব্যাংক ব্যবসা করবে কীভাবে? সে বিবেচনা থেকে ব্যাংকগুলোকে করের টাকা দেওয়া ঠিক আছে। তবে উচিত হচ্ছে, ব্যাংকের খারাপ পরিস্থিতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের যথাযথ বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। এ বিষয়ে আমাদের ঘাটতি আছে।’

মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, ব্যাংক বসে গেলেও করের টাকা দিয়ে যাতে সহযোগিতা না করতে হয়, সেই পথে যাওয়ার দিন এসেছে।

কোন বছরে কত দিল সরকার

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শুরু থেকেই ‘মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ’ নামে ব্যাংকগুলোকে টাকা দেওয়ার জন্য বরাদ্দ রেখে আসছিল সরকার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এটির নাম পাল্টিয়ে রাখা হয় ‘সমমূলধন বিনিয়োগ’।

অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রথম সোনালী ব্যাংককে মূলধন পুনর্ভরণ হিসেবে ১২৫ কোটি টাকা দেয়। ২০১০-১১ অর্থবছরে কোনো ব্যাংককে অর্থ দেওয়া হয়নি। ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকগুলোকে দিতে ৩৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। তবে সেবার কোনো অর্থ ছাড় করা হয়নি। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ৫৪১ কোটি টাকা ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে ৪ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়।

অর্থমন্ত্রী মোট ঋণ বিতরণের সঙ্গে খেলাপি ঋণের পরিমাণের তুলনা করলে তো হবে না। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার সময় খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা, আর তা এখন ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। মানুষ তো শতাংশ দেখবে না, দেখবে পরিমাণ।
সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।

এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও তাতে কুলোয়নি। সে জন্য ব্যাংকগুলোকে দিতে হয় ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ২ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখে পুরোটা দেওয়া হয়। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখলেও শেষ পর্যন্ত কোনো টাকা দেওয়া হয়নি।

দেশের ব্যাংক খাতে বড় কেলেঙ্কারিগুলো শুরু হয় মূলত ২০১০-১১ অর্থবছরে। এর মধ্যে ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংকে হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং জনতা ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারিতে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটে।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আফজাল করিম প্রথম আলোকে জানান, মূলধন ঘাটতি ৬ হাজার ৯০০ কোটি থেকে কমিয়ে তিনি ৫ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনতে পেরেছেন। ব্যাংকারদের সঙ্গে নিয়ে ২০২৬ সালে এ ঘাটতি শূন্য করার কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক আমলের চিত্র

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে মূলধন পুনর্ভরণ হিসেবে সোনালী ব্যাংককে ১৭২ কোটি ৭৮ লাখ, কৃষি ব্যাংককে ৬০ কোটি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) ৩০ কোটি টাকা দিয়েছে বিএনপি সরকার। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৬-০৭ অর্থবছরে কাউকে কোনো অর্থ দেয়নি। তবে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে মূলধন পুনর্ভরণ হিসেবে সোনালী ব্যাংককে ৪০০ কোটি, কৃষি ব্যাংককে ৫০ কোটি এবং রাকাবকে ৪০ কোটি টাকা দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

২০০৮-০৯ অর্থবছরের অর্ধেক সময় তত্ত্বাবধায়ক ও বাকি অর্ধেক সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বাস্তবায়ন করে। ওই অর্থবছরে মূলধন পুনর্ভরণ হিসেবে কৃষি ব্যাংক ৫৫০ কোটি ও রাকাব ৩৫০ কোটি টাকা পায়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মহাজোট সরকার শুধু সোনালী ব্যাংককে ১২৫ কোটি টাকা দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগ এখন ব্যাংকগুলোকে সরাসরি টাকা দেওয়ার চেয়ে বন্ড ছাড়া, বোনাস শেয়ার ঘোষণা ও খেলাপি ঋণ কমানোর দিকেই বেশি আগ্রহী। এ নিয়ে অবশ্য কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এ-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত উপায় হচ্ছে, নিট মুনাফা অর্জন করে তা বণ্টনের পরিবর্তে বোনাস শেয়ার ছাড়া। এ বিভাগই আবার বলছে, দীর্ঘদিন রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো মুনাফা অর্জনের ধারায় না থাকায় এ উপায় বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ কম।

এদিকে গত শনিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদকে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য শুনিয়ে সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শুধু মূলধন ঘাটতি পূরণের টাকা দেওয়া আর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি তো ব্যাংক খাতের সমস্যা না। পুরো ব্যাংক খাত আছে মূলত সুশাসনের ঘাটতিতে। এ ঘাটতি পূরণে সরকারের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। আর অর্থমন্ত্রী মোট ঋণ বিতরণের সঙ্গে তুলনা করে খেলাপি ঋণের পরিমাণের তুলনা করলে তো হবে না। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার সময় খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা আর এখন তা ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। মানুষ তো শতাংশ দেখবে না, দেখবে পরিমাণ।