মূল্যস্ফীতি কি মুদ্রানীতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে

সংস্থাটির প্রধান কাজ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে মানুষকে স্বস্তিতে রাখা। ছয় মাস পরপর মুদ্রানীতি ঘোষণার মাধ্যমে কাজটি করার চেষ্টা করে সংস্থাটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকছবি: সংগৃহীত

দেশে টানা ১৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। সাধারণত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হলো সুদের হার বাড়ানো। কিন্তু সেটি করেও অর্থাৎ সুদহার বাড়ানো হলেও মূল্যস্ফীতি লাগামছাড়াই রয়ে গেছে; যে কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ এখন বেশ কষ্টে আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কাজ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে মানুষকে স্বস্তিতে রাখা। প্রতি ছয় মাস পরপর মুদ্রানীতি ঘোষণার মাধ্যমে কাজটি করার চেষ্টা করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। সে ধারাবাহিকতায় আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতিতে নতুন মুদ্রানীতিতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা নিয়ে এখন সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কাজ করছেন। এদিকে ব্যাংক খাতেও বিশৃঙ্খলা চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাপানো টাকায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সংকটে পড়া কয়েকটি ব্যাংক। এসবও এখন মাথাব্যথার কারণ। সে অনুযায়ীই পদক্ষেপ নিতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন করে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ কম। সরকারের চাপে সময়মতো সঠিক নীতি নেওয়া যায়নি। এ কারণে সংকট দীর্ঘমেয়াদি হয়েছে। তবে ব্যাংকঋণের সুদহার ইতিমধ্যে ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তাই এখন নীতি সুদের হার বাড়িয়ে টাকাকে আরও দামি করে তোলা হতে পারে। এতে ঋণের সুদের হার আরও বাড়বে। তবে সবকিছু নির্ধারণ করবে মুদ্রানীতি কমিটি।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সুদের হার বাজারভিত্তিক রেখেই মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করে যেতে হবে। ডলার-সংকটও অনেকটা কমে এসেছে। কোনো অবস্থাতেই আর টাকা ছাপানোর দিকে যাওয়া যাবে না।
—আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)।

জানা গেছে, শিগগির মুদ্রানীতি কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। এই কমিটিতে গভর্নরসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রয়েছেন অর্থনীতিবিদ সাদিক আহমেদ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান মাসুদা ইয়াসমীন।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সুদের হার বাজারভিত্তিক রেখেই মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করে যেতে হবে। ডলারের সংকটও অনেকটা কমে এসেছে। কোনো অবস্থাতেই আর টাকা ছাপানোর দিকে যাওয়া যাবে না। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক আবারও টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া শুরু করেছে। তারা টাকা ছাপিয়ে সংকটে থাকা শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকেও ঋণ দিয়ে যাচ্ছে। এভাবে চললে মুদ্রানীতির লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ব্যাংক খাতের করুণ অবস্থা ঠিক করাটা এখন অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। সঠিক তদারকি ও উন্নয়নের অভাবে পুরো খাত মৃতপ্রায় হয়ে গেছে। এ কারণে অনেক নীতি কাজে দিচ্ছে না। অর্থ পাচার অব্যাহত আছে। সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ব্যাংক খাতের আর কতটা ক্ষতি করার সুযোগ তারা দেবে।

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা ও জিডিপিতে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই লক্ষ্য ঠিক রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকও মুদ্রানীতি প্রণয়ন করবে।

দেশে মার্কিন ডলারের পাশাপাশি স্থানীয় টাকারও সংকট চলছে, বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্যহীনতায় রিজার্ভ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এ ছাড়া ব্যাংক খাতও নিয়ন্ত্রণহীন। মোটা দাগে এসবই হচ্ছে এখন দেশের আর্থিক খাতের প্রধান সমস্যা। এসব সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তারা বছরে দুবার মুদ্রানীতির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা রক্ষার চেষ্টা করে থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরে নীতি সুদের হার দুই দফা বাড়িয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে সরকারের ব্যাংকঋণের সুদে। সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকঋণের সুদে। প্রথম দফায় গত জানুয়ারিতে নীতি সুদহার ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয় ও গত মে মাসে তা ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। এর ফলে ঋণের সুদের হার বেড়ে সাধারণত ঋণের চাহিদা কমে যায়। ফলে গত এপ্রিলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে ৯ দশমিক ৯০ শতাংশে নামে। এভাবে অর্থনীতিতে অর্থের প্রবাহ কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি কাজ করছে না। ১৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। সর্বশেষ মে মাসে তা বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের মে মাসে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা খরচ হয়েছিল, সেটি কিনতে এ বছরের মে মাসে খরচ হয়েছে ১০৯ টাকা ৮৯ পয়সা। গত মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ হয়েছে, যা আগের মাসে ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। এপ্রিলে তা ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ ছিল।

এমন পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কামাল মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেওয়া হয়েছে। এখন এর সঙ্গে রাজস্ব নীতি ও অন্যান্য নীতিকে সমন্বয় করতে হবে। শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা যাবে না। এ জন্য বাজার ব্যবস্থাপনাও উন্নত করতে হবে। বাজারে বিশৃঙ্খলার ফলে অকারণেও হঠাৎ পণ্যের দাম ওঠানামা করছে। এর মাধ্যমে মানুষের পকেট কাটছেন কিছু ব্যবসায়ী। এতেই বোঝা যাচ্ছে সমন্বয়হীনতা কতটা প্রকট হয়েছে।