শাখা খোলার পরিবর্তে যন্ত্রে সেবা দেওয়ার দিকে ঝুঁকছে ব্যাংকগুলো

নগদ অর্থের লেনদেনে এটিএম এখন সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয়রয়টার্স

বাংলাদেশে কার্যরত বিদেশি ব্যাংকগুলো অনেক আগেই নতুন শাখা খোলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এখন স্থানীয় ব্যাংকগুলোও একই পথে হাঁটছে। এর কারণ হলো, ব্যাংকগুলো সেবা দেওয়ার জন্য শাখার পরিবর্তে এখন ডিজিটাল মাধ্যমকে বেছে নিচ্ছে। ফলে ব্যাংক সেবার অবকাঠামো বদলে যাচ্ছে।

অনেক ভালো ব্যাংকও ২০২৩ সালে নতুন কোনো শাখা খোলেনি। তবে সেবা ও গ্রাহক বাড়াতে তারা অ্যাপসনির্ভর সেবা ও নতুন ডিজিটাল অবকাঠামো চালু করে চলেছে। যেমন এসব ব্যাংক নগদ টাকা জমা ও উত্তোলনের জন্য এটিএমের পরিবর্তে নতুন ক্যাশ রিসাইক্লিং মেশিন (সিআরএম) বসিয়েছে। এটাকেই বর্তমানে সঠিক পথ বলে মনে করছেন ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ব্যাংকগুলোর শাখা বেড়েছে ১৪৩টি। এর আগে ২০২২ সালে ২০০টি ও ২০২১ সালে ২৬৮টি নতুন শাখা খোলা হয়েছিল। এর আগে ২০২০ সালে করোনার প্রকোপের কারণে শাখা খোলা হয়েছিল ১০৩টি। ফলে ব্যাংকগুলোতে নতুন জনবল নিয়োগ কমে গেছে। গত বছর যেসব ব্যাংক শাখা খুলেছে, তার বেশির ভাগই চতুর্থ প্রজন্মের, অর্থাৎ নতুন ব্যাংক। পাশাপাশি তারল্য সংকটে পড়া কিছু ব্যাংক অবশ্য শাখা-উপশাখা বাড়িয়ে আমানত টানার চেষ্টা করছে।

এখন সিআরএম যন্ত্রে সব ব্যাংক ভালো সম্ভাবনা দেখছে। কারণ, এক যন্ত্রে জমা ও উত্তোলন সুবিধা মিলছে। এভাবে ব্যাংকের শাখার ওপর চাপ কমে আসবে। সামনের দিনে ব্যাংকের সেবার জন্য ব্যাংকারদের ওপর নির্ভরশীলতা আরও কমবে। আর যন্ত্রেই মিলবে আরও অনেক সেবা।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, এমডি, এমটিবি

ব্যাংকাররা বলছেন, গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোর জন্য এখন শাখা খোলার প্রয়োজনীয়তা কমে গেছে। গ্রাহকেরা ঘরে বসেই অ্যাপসের মাধ্যমে সেবা নিতে পারছেন। নগদ টাকার প্রয়োজন হলে কার্ডের মাধ্যমে যেকোনো ব্যাংকের বুথ থেকে টাকা তুলতে পারছেন। শাখার পেছনে যে খরচ হয়, এসব মাধ্যমে সেবা দিলে ব্যাংকগুলোর খরচও বেশ কম হয়। সব মিলিয়ে সামনের দিনে শাখা খোলা আরও কমবে। তখন নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে বিভিন্ন এলাকায় উপশাখা, সিআরএম যন্ত্র স্থাপনে জোর দেবে ব্যাংকগুলো।

ব্যাংকগুলো এখন শাখার পাশাপাশি উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হিসাব খোলা, নগদ টাকা জমা ও উত্তোলন, ঋণসহ অন্যান্য সেবা দিচ্ছে। সেই সঙ্গে কার্ডের মাধ্যমে নগদ টাকা জমা ও উত্তোলন করা যাচ্ছে এটিএম ও সিআরএম যন্ত্রে। এ ছাড়া অনলাইন ব্যাংকিং ও অ্যাপসের মাধ্যমেও অনেক গ্রাহক এখন ব্যাংকিং লেনদেন করছেন।

ব্যাংক শাখার চিত্র

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০১৯ সালে দেশি-বিদেশি ব্যাংক মিলিয়ে মোট শাখা ছিল ১০ হাজার ৫৬৮টি, যা ২০২০ সালে বেড়ে হয় ১০ হাজার ৬৭১টি। তা বেড়ে ২০২১ সালে ১০ হাজার ৯৩৯টি ও ২০২২ সালে ১১ হাজার ১৩৯টিতে ওঠে। আর ২০২৩ সালে ব্যাংকের শাখা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ২৮৪টি।

দেখা গেছে, ২০২৩ সালে প্রাইম ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ণ ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল), ব্র্যাক ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকসহ (এমটিবি) কিছু ব্যাংক নতুন কোনো শাখা খোলেনি। তবে উপশাখা ও সিআরএম যন্ত্র স্থাপন বাড়িয়েছে। ২০২২ সালে প্রাইম ব্যাংকের শাখা ছিল ১৪৬টি, যা এখনো একই রয়ে গেছে। সিটি ব্যাংকের শাখাও বাড়েনি, যা এখন ১৩৩টি। ২০২২ সাল থেকে এমটিবির শাখা ১১৯টি ও ব্র্যাক ব্যাংকের ১৮৭টিতেই আছে।

২০২৩ সালে ইসলামী ব্যাংকও কোনো শাখা বাড়ায়নি। ব্যাংকটির শাখা এখন ৩৯৪টি। তবে গত বছরে উপশাখার সংখ্যা ২২৮ থেকে বাড়িয়ে ২৪৯টিতে উন্নীত করেছে ব্যাংকটি। পাশাপাশি এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার এজেন্টের সংখ্যা ২ হাজার ৬৯৪ থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ৭৭১ করেছে।

ব্যবসার মডেল ভিন্ন হওয়ায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংক গত বছর ৫টি শাখা খুলেছে। ব্যাংকটির শাখা বেড়ে হয়েছে ২৪৩টি। পাশাপাশি এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা ও এটিএম/সিআরএম যন্ত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে এই ব্যাংক। পূবালী ব্যাংক গত বছর শাখা খুলেছে ৬টি, তাতে তাদের শাখা বেড়ে হয়েছে ৫০৪টি। এ ছাড়া গত বছরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক ৩টি, অগ্রণী ব্যাংক ৬টি ও জনতা ব্যাংক ৬টি শাখা খুলেছে। নতুন ব্যাংকগুলো অবশ্য শাখা খুলে যাচ্ছে।

নতুন প্রজন্মের দুটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রথম আলোকে বলেন, সব বিভাগীয় ও বড় জেলা শহরে ব্যাংকের শাখা না থাকলে চলে না। মানুষ ব্যাংকটি সম্পর্কে জানতে পারে না। এ জন্য এখনো শাখা খোলার বিকল্প দেখছেন না তাঁরা। এই মত অবশ্য পুরোনো ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরোনো ব্যাংকগুলো শাখা খোলার ব্যাপারে তেমন আগ্রহী না। তবে সব ব্যাংকই নতুন গ্রাহক ও ব্যবসা বাড়াতে আগ্রহী। এ জন্য উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং মাধ্যম কাজে লাগছে। আমাদের মতো ব্যাংকগুলো আর্থিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবসা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এতে আগের ১০ জনের পরিবর্তে ৩ জন দক্ষ জনবল দিয়ে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। সেবার মানেও কোনো আপস করা হচ্ছে না।’

ভিন্ন চিত্র ডিজিটাল অবকাঠামোয়

ব্যাংকগুলোর শাখা খোলায় ধীরগতি দেখালেওএর ঠিক সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র দেখা গেছে ডিজিটাল অবকাঠামো বাড়ানোর ক্ষেত্রে। প্রতিটি ব্যাংক ২০২৩ সালে ডিজিটাল পণ্য চালু করেছে। কোনো কোনো ব্যাংক অ্যাপসের মাধ্যমে ঘরে বসে হিসাব খোলা, আমানত জমা, ঋণ প্রস্তাব জমা দেওয়ার সেবা চালু করেছে। ঋণপত্র (এলসি) খোলার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে কিছু ব্যাংক। এটিএমের পাশাপাশি সিআরএম যন্ত্রে ঝুঁকছে ব্যাংকগুলো। কারণ, এতে এক যন্ত্রেই টাকা জমা ও উত্তোলন সুবিধা মিলছে। ইতিমধ্যে পূবালী, ঢাকা, সিটি, ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক এটিএম বুথকে সিআরএম বুথে পরিণত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ জন্য সব ব্যাংক ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিচ্ছে ক্যাশ ডিপোজিট যন্ত্র (সিডিএম)।

২০২২ সালে দেশে এটিএম ছিল ১৩ হাজার ৩৬৭টি, যা ২০২৩ সালের শেষে বেড়ে হয়েছে ১৩ হাজার ৪৩৬। একই সময়ে সিআরএম যন্ত্র ২ হাজার ৪৮৯ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৩৫টি। সিডিএম যন্ত্র ২০২২ সালে ছিল ১ হাজার ৯৪টি, যা গত বছরের শেষে দাঁড়িয়েছে ২৬৩। গ্রাহকেরা এক ব্যাংকের কার্ড দিয়ে অন্য ব্যাংকের যন্ত্রে টাকা জমা করা ও উত্তোলনের সেবা নিতে পারছেন।

এ নিয়ে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এখন সিআরএম যন্ত্রে সব ব্যাংক ভালো সম্ভাবনা দেখছে। কারণ, এক যন্ত্রে জমা ও উত্তোলন সুবিধা মিলছে। এভাবে ব্যাংকের শাখার ওপর চাপ কমে আসবে। সামনের দিনে ব্যাংকের সেবার জন্য ব্যাংকারদের ওপর নির্ভরশীলতা আরও কমবে। আর যন্ত্রেই মিলবে আরও অনেক সেবা।’