খেলাপি ঋণ অবলোপনে নতুন নীতিমালা ঘোষণা, যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে

খেলাপি ঋণপ্রতীকী ছবি

কাগজে কলমে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে আগের শর্ত শিথিল করে নতুন ঋণ অবলোপন নীতিমালা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন কোনো ঋণ টানা দুই বছর ‘মন্দ ও ক্ষতিজনক মানে খেলাপি’ থাকলেই তা অবলোপন করা যাবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে। আগে এ সময়সীমা ছিল তিন বছর।

পাশাপাশি অবলোপনকৃত ঋণ আদায় জোরদার করতে কিছু কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে নিজ নিজ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) নেতৃত্বে ‘অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট’ গঠন করা। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক এমডিদের নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে অবলোপন করা ঋণ আদায়সংক্রান্ত শর্ত যুক্ত করতে বলেছে। এমডির পুনর্নিয়োগে অন্যতম মানদণ্ড হিসেবে অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে তাদের অর্জন বিবেচনা করা হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল এক প্রজ্ঞাপনে ঋণ অবলোপন এবং তা আদায় কার্যক্রম জোরদারে ইউনিট গঠন ও এর কার্যাবলিসংক্রান্ত নীতিমালায় এসব শর্ত যুক্ত করেছে। দেশের ব্যাংক খাতের পুরোনো ‘রোগগুলো’ সারিয়ে তুলতে চলতি মাসের শুরুতে রোডম্যাপ বা পথনকশা ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই পথনকশায় খেলাপি ঋণ কমাতে অবলোপনসহ বেশ কিছু কর্মপরিকল্পনার কথা জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অবলোপন নীতি বাস্তবায়নের ফলে কত টাকা খেলাপি ঋণ কমবে, তা-ও জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের হিসাবে, দুই বছর খেলাপি থাকা ঋণ অবলোপন করলে সার্বিক খেলাপি ঋণ কমবে ৪৩ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্য ২০২৬ সালের মধ্যে সার্বিক খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে নামা। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯ শতাংশ। ফলে নতুন নীতিমালা মেনে ঋণ অবলোপন করলেই খেলাপি ঋণ লক্ষ্যের নিচে নেমে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।

তিনটি ব্যাংকের এমডি প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে বলেন, যেসব ঋণ অবলোপন করা হবে তা বেশ পুরোনো। অনেক আগে এসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এসব ঋণের দায় কোনোভাবেই বর্তমান এমডিদের হতে পারে না। আর ঋণ আদায় জোরদার করার কাজটি এমডিরা সব সময়ই করে থাকেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ঋণের শ্রেণিমান যা–ই থাকুক না কেন, কোনো মৃত ব্যক্তির নিজ নামে বা তাঁর একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ থাকলে ব্যাংক সেই ঋণ অবলোপন করতে পারবে। তবে একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির উপার্জনক্ষম উত্তরসূরি রয়েছে কি না, তা বিবেচনায় নিতে হবে।

ঋণ অবলোপনের পদ্ধতি

নীতিমালায় ঋণ অবলোপনের পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এতে বলা হয়েছে, ঋণের বিপরীতে বন্ধকিকৃত সম্পত্তি নিয়ম মেনে বিক্রয়ের চেষ্টা গ্রহণ করা হলে এবং ঋণের নিশ্চয়তা প্রদানকারী ব্যক্তির কাছে পাওনা অর্থ আদায়ের চেষ্টা ব্যর্থ হলে সেই ঋণ অবলোপন করা যাবে। এ ক্ষেত্রে অবলোপনের আগে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করতে হবে। তবে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ এবং মৃত ব্যক্তির ঋণ মামলা দায়ের ছাড়া অবলোপন করা যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, সংশ্লিষ্ট ঋণের হিসাবের মধ্যে স্থগিত সুদ বাদ দেওয়ার পর অবশিষ্ট স্থিতি অবলোপনের করা যাবে। অবলোপন করা প্রতিটি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি পর্যাপ্ত না হলে চলতি বছরের আয় খাত থেকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে। কোনো ঋণ আংশিকভাবে অবলোপন করা যাবে না।
গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট ৬৮ হাজার ২৩ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছিল। ওই সময়ে অবলোপন করা ঋণের স্থিতি ছিল ৪৯ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা।

আদায় ও তদারকি

বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ঋণ আদায়ে এমডির নেতৃত্বে ‘অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট’ গঠন করে এমডির দুই ধাপ নিচে নন এমন কর্মকর্তাকে ইউনিটের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। যে শাখা বা ইউনিটের ঋণ অবলোপন করা হবে, সেই শাখা বা ইউনিটের একজনকে ওই ঋণের আদায় কার্যক্রমে যুক্ত করতে হবে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এই ইউনিট গঠন ও ৩০ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় জনবল ইউনিটে নিয়োগ দিতে হবে।

এমডিদের নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে অবলোপন করা ঋণ আদায়সংক্রান্ত শর্ত যুক্ত করতে বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায়। এতে বলা হয়, এমডির পুনর্নিয়োগে অন্যতম মানদণ্ড হিসেবে অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে তাদের অর্জন বিবেচনা করতে হবে। অবলোপন করা ঋণ আদায় ইউনিটকে প্রতি মাসে সভা করতে হবে এবং সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত কার্যবিবরণীতে লিপিবদ্ধ করতে হবে। প্রতি ত্রৈমাসিকে অবলোপন করা ঋণ আদায়ের অগ্রগতি পর্ষদকে অবহিত করতে হবে।

অবলোপনকৃত ঋণের বিপরীতে আদায়কৃত অর্থের ৫ শতাংশ প্রণোদনা হিসেবে এই ঋণ আদায়ে যুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। প্রণোদনার মোট অর্থের মধ্যে ১০ শতাংশ পাবেন ব্যাংকের এমডি। ভবিষ্যতে অবলোপন করা ঋণ আদায়ে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি কাজ করলে সেই ঋণ বিক্রয় করা যাবে।