এক যুগ পর বাণিজ্যিক ব্যাংকের চরিত্রে ফিরেছে সোনালী ব্যাংক

সোনালী ব্যাংক লিমিটেডেফাইল ছবি

এক যুগ আগে সংঘটিত হল–মার্ক গ্রুপের আর্থিক কেলেঙ্কারির পর রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে হাত গুটিয়ে নিয়েছিল। এরপর আমানত বাড়লেও ঋণ দেওয়ার পরিবর্তে তা আরও কমিয়ে এনেছিল। ঋণের ঝুঁকি এড়াতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের চরিত্র ছেড়ে ট্রেজারি ব্যাংকে রূপ নিয়েছিল ব্যাংকটি। ফলে ঋণ দিয়ে যে পরিমাণ সুদ আয় হতো, তার চেয়ে বেশি ব্যয় হতো আমানতকারীদের সুদ পরিশোধে। তবে বছর আড়াই আগে ব্যাংকটি বড় আবার আকারে বেছে বেছে ঋণ দিতে শুরু করে। তাতে প্রকৃত সুদ আয় বাড়ছে।

প্রায় এক যুগ পর আবার বাণিজ্যিক ব্যাংকের চরিত্র ফিরে পেতে শুরু করেছে ব্যাংকটি। সেই সঙ্গে এটির সার্বিক আর্থিক অবস্থারও উন্নতি হতে শুরু করেছে। সোনালী ব্যাংকের আর্থিক তথ্য পর্যালোচনায় এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

আমরা এখন ট্রেজারি ব্যবসার পরিবর্তে ঋণে মনোযোগ বাড়িয়েছি। এ জন্য প্রকৃত সুদ আয় হচ্ছে। যেসব ভালো গ্রাহক যথাযথ নিয়মকানুন মেনে আবেদন করছেন, তাঁরা ঋণ পাচ্ছেন।
মো. আফজাল করিম, এমডি, সোনালী ব্যাংক

এদিকে শীর্ষ খেলাপি গ্রাহকদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে সোনালী ব্যাংক কার্যত ব্যর্থই রয়ে গেছে। চলতি বছরের প্রথম ১১ মাস জানুয়ারি-নভেম্বরে ব্যাংকটি শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মাত্র ২০ শতাংশ অর্থ আদায় করতে পেরেছে। আর হল–মার্ক গ্রুপের মতো পুরোনো কিছু খেলাপি ঋণ অবলোপন করে খেলাপি ঋণ কমিয়েছে ব্যাংকটি। এসব অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায় হয়েছে ১ শতাংশেরও কম।

সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে সর্বোচ্চ সময় দিচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী।

ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে গত বছরের আগস্টে যোগ দেন মো. আফজাল করিম। গত রোববার নিজ কার্যালয়ে বসে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখন ট্রেজারি ব্যবসার পরিবর্তে ঋণে মনোযোগ বাড়িয়েছি। এ জন্য প্রকৃত সুদ আয় হচ্ছে। যেসব ভালো গ্রাহক যথাযথ নিয়মকানুন মেনে আবেদন করছেন, তাঁরা ঋণ পাচ্ছেন। এতে ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতিরও উন্নতি হয়েছে।’

আফজাল করিম আরও বলেন, ‘গত বছর ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরে ঋণ বেড়েছে আরও ১০ হাজার কোটি টাকা। ঋণ পেয়েছে প্রাণ-আরএফএল, ব্র্যাক, টিএমএসএসের মতো ব্যবসায়ী ও এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো। পাশাপাশি ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং কৃষি খাতেও ঋণ বেড়েছে।’

এদিকে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী সংগ্রহেও জোর দিচ্ছে সোনালী ব্যাংক। ব্যাংকটি সম্প্রতি প্রবাসী আয় আনতে অ্যাপ চালু করেছে; সরকারের আড়াই শতাংশের পাশাপাশি ব্যাংকটিও সমপরিমাণ প্রণোদনা দিচ্ছে।

প্রবাসী আয় আনতে অ্যাপ চালু করেছে সোনালী ব্যাংক
প্রথম আলো

আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি

২০১২ সালে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির সময় সোনালী ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ ছিল ৫৯ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা, আর ঋণ ছিল ৩৭ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। একই সময়ে হল–মার্ক ও এর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি তালিকায় যুক্ত হওয়ায় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। আগের বছর ২০১১ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৬ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। ২০১২ সালে ব্যাংকটির আমদানি ও রপ্তানি ব্যবসার পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২৮ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা ও ৮ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা।

কেলেঙ্কারির পর আমানত বাড়লেও ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ব্যাংকটি ঋণ বিতরণ কমিয়ে দেয়। এরপর ২০১৬ সাল থেকে ধীরে ধীরে ঋণ বাড়াতে শুরু করে। এ সময়ে কিছু প্রভাবশালী গ্রাহক ব্যাংকটি থেকে অর্থায়ন সুবিধা পায়। ২০২১ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির প্রকৃত সুদ আয় ঋণাত্মক ছিল। ২০২১ সালে এই ব্যাংক ঋণে আরও মনোযোগী হলে প্রকৃত সুদ আয় পাওয়া শুরু হয়। এই ব্যাংকে ২০২১ সালে ঋণ ১১ হাজার কোটি টাকা, ২০২২ সালে ১৫ হাজার কোটি টাকা ও চলতি বছরের ৯ মাসে ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়ে।

২০২২ সালে সোনালী ব্যাংকের প্রকৃত সুদ আয় হয় ২০৯ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের ৯ মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮০ কোটি টাকা। হল–মার্ক কেলেঙ্কারির কারণে ২০১২ সালে আড়াই হাজার কোটি টাকা লোকসান হলেও এখন ধীরে ধীরে মুনাফা বাড়ছে। গত বছরে প্রকৃত মুনাফা হয়েছে ৩৭১ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে ব্যাংকটির ৭ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা মূলধন–ঘাটতি হলেও ২০২২ সালে তা কমে ৪ হাজার ৫৯১ কোটি টাকায় নামে।

এদিকে গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটিতে ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা ও আমানত বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৪ কোটি টাকা। পাশাপাশি ২০২২ সালে ব্যাংকটির আমদানি ব্যবসা বেড়ে ৪৩ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকায় ও রপ্তানি ব্যবসা ২ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা উঠেছে। তবে খেলাপি আগের মতোই ঋণ রয়ে গেছে, যার পরিমাণ গত সেপ্টেম্বরে ছিল ১৩ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ মোট ঋণের ১৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানান, সরকারি আমদানির বড় অংশ হয় সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে। এ জন্য আমদানি ব্যবসা বেড়েছে। পাশাপাশি কিছু রপ্তানিকারকও ব্যাংকটির গ্রাহক। সরকারি সেবার কারণে আমদানি বাড়লেও এতে আয় নেই বললেই চলে।

খেলাপি ঋণ আদায়ের চেষ্টা

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর পর্যন্ত শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে সোনালী ব্যাংকের পাওনা ছিল ৪ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। আর ঋণ অবলোপন করা শীর্ষ ২০ গ্রাহকের কাছে পাওনা ছিল ২ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা।

এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপি গ্রাহক হল–মার্ক গ্রুপের ঋণ ৪৮৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া গ্রুপটির ১ হাজার ২২৯ কোটি টাকার ঋণ সোনালী ব্যাংক অবলোপন করেছে। তবে চলতি বছরে হল–মার্ক গ্রুপ থেকে ব্যাংকটি মাত্র ৫ কোটি টাকার মতো আদায় করেছে। হল–মার্ক সংশ্লিষ্ট টিঅ্যান্ড ব্রাদার্সের খেলাপি ঋণ হচ্ছে ৪৯০ কোটি টাকা।

এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের ঋণখেলাপিদের মধ্যে রয়েছে মডার্ন স্টিল, তাইপেই বাংলা ফেব্রিকস, ফেয়ার ট্রেড ফেব্রিকস, রহমান গ্রুপ, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, লীনা গ্রুপ, রতনপুর স্টিল, অ্যাপেক্স উইভিং, বিশ্বাস গার্মেন্টস, মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক, সোনালি জুট। 

এসব খেলাপি ঋণ কীভাবে আদায় হবে, এ প্রশ্নের জবাবে সোনালী ব্যাংকের এমডি আফজাল করিম বলেন, ‘আমরা হল–মার্ক গ্রুপসহ দীর্ঘদিন খেলাপি আছে, এমন গ্রাহকদের সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছি।

এতে ভালো টাকা আদায় সম্ভব হবে। ২০২৭ সালে সোনালী ব্যাংক স্মার্ট ব্যাংকে পরিণত হবে, এ লক্ষ্যে কাজ চলছে। এ জন্য প্রবাসী আয় আনতে অ্যাপস চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি এখন অনলাইনেই সোনালী ব্যাংকের গ্রাহক হওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকিং সেবা মিলছে।’ এ ছাড়া ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার এক অঙ্কে নেমে আসবে বলে আশা করেন তিনি।  

সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ গ্রাহকদের বড় অংশই সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠান। আবার বেসরকারি শিল্পগোষ্ঠীও রয়েছে তালিকায়। ব্যাংকটি কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানের টাকাও সময়মতো ফেরত পাচ্ছে না।

২০২২ সালভিত্তিক আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটির বেসরকারি শীর্ষ গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ, থারমেক্স গ্রুপ, হল–মার্ক গ্রুপ (২১ প্রতিষ্ঠান), টি অ্যান্ড ব্রাদার্স, ব্র্যাক। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর, বিমান বাংলাদেশ, পায়রা বন্দর, সোনালী ব্যাংকের ইউকে কার্যক্রম, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি), বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (বিএডিসি), বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিএসএফআইসি) এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।

আফজাল করিম প্রথম আলোকে বলেন, পুনঃ তফসিলের পর বেক্সিমকো গ্রুপের সব ঋণ এখন নিয়মিত আছে। অন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও টাকা আদায়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।