ছয় ব্যাংক থেকে টাকা পেতে আর কোনো সমস্যা হবে না: গভর্নর

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরফাইল ছবি

অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে যে ছয়টি ব্যাংক তারল্যসংকটে রয়েছে, তাদের লেনদেন স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমানতকারীরা যাতে চাহিদামতো টাকা তুলতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে এসব ব্যাংককে ইতিমধ্যে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধার দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোর আরও টাকার প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই সহায়তা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, সব ব্যাংক আমানতকারীর পাশে সরকার থাকবে।

নগদ অর্থের সমস্যায় থাকা বেসরকারি খাতের ছয়টি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও প্রতিনিধিদের নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার একটি বৈঠক করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। সভা শেষে তাঁদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন আহসান এইচ মনসুর। ব্যাংক ছয়টি হলো ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক।

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সমস্যায় থাকা ব্যাংকগুলোকে বড়ভাবে সাহায্য করা হচ্ছে। একই সঙ্গে এসব ব্যাংক নিবিড় তদারকিতে রাখা হয়েছে। গ্রাহকের স্বার্থ দেখতে আমরা বদ্ধপরিকর। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রত্যেক আমানতকারীর জমা করা অর্থের সুরক্ষা দেওয়া হবে। কোনো ব্যাংকে তারল্য সমস্যা হলে তাতে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা তারল্যসহায়তা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে আরও সহায়তা দেওয়া হবে। আমানতকারীদের স্বার্থ পুরোপুরি সুরক্ষিত থাকবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আরও বলেন, ‘ব্যাংকের সব শাখা থেকে গ্রাহকেরা তাঁদের চাহিদামতো টাকা তুলে পারছেন। আগামী দিনেও টাকা তুলতে কোনো সমস্যা হবে না। ব্যাংকে যে অস্থিরতা রয়েছে, তা থেকে বের হয়ে আসতে চাই। ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী অবস্থানে নিতে চেষ্টা

করা হচ্ছে। এতে জনগণের আস্থা থাকা উচিত। জনগণের জন্য যা ভালো হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সেই উদ্যোগ নেবে। গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় যা প্রয়োজন তাই করা হবে।’

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আহসান মনসুর বলেন, ‘একটি ব্যাংকের সব গ্রাহক টাকা তুলে ফেলতে চাইলে পৃথিবীর কোনো ব্যাংকই সব টাকা একসঙ্গে ফেরত দিতে পারবে না। তাই আমরা গ্রাহকদের বলব, সবাই একসঙ্গে টাকা তুলতে যাবেন না। যে ব্যাংকেই টাকা থাকুক না কেন, তা নিরাপদ থাকবে। ব্যাংকে থাকা আমানত নিরাপদ থাকবে, আমরা সেই মর্যাদা দেব। ব্যাংকে যে অস্থিরতা রয়েছে, তা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে চাই।’

টাকা আসছে কোন উৎস থেকে

মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার পর টাকা ছাপানোর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। এখন কেন তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললেন - সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, টাকা ছাপানো হবে না, এই সিদ্ধান্ত থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাময়িকভাবে সরে এসেছে। তবে ব্যাংকগুলোকে তারল্যসহায়তা দেওয়ার প্রক্রিয়াটিকে পুরোপুরি টাকা ছাপানো বলা যাবে না। এখানে এক হাতে বাজার থেকে টাকা তুলে অন্য হাতে ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হবে। মুদ্রানীতি আগের মতো সংকোচনমূলক থাকবে।

তারল্যসংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে টাকা ছাপিয়ে সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান উদ্যোগের পার্থক্য কী, জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, ‘এসব ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। টাকা চুরি বন্ধ করা হয়েছে। সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়েছে।

সূচকগুলো নিয়মিত তদারকির মধ্যে আনা হয়েছে। বাচ্চারা ললিপপ চাইলে বাবারা যেমন দিতে থাকেন, আগে এভাবে টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এক ইসলামী ব্যাংককে ছাপিয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এসব টাকার কোনো হিসাব মেলেনি।’

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘১০ টাকা ধার দিয়ে ১০ টাকা বাজার থেকে তুলে নিলে কোনো সমস্যা হবে না। এটা একধরনের স্টেরিলাইজেশন পদ্ধতি ব্যবহারের মতো। এর ফলে প্রকৃতপক্ষে টাকা ছাপানো বৃদ্ধি পাবে না। আমাদের বড় লক্ষ্য হলো মূল্যস্ফীতি কমানো ও আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা।’

স্টেরিলাইজেশন হলো এমন একটি পদ্ধতি, যা ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য তুলে নেয়। সাধারণত সরকারি বন্ড বিক্রি করে এর মাধ্যমে অতিরিক্ত নগদ অর্থ হাতে থাকা ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে টাকা নিয়ে নেওয়া হয়। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে অতিরিক্ত অর্থ তুলে নিয়ে মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে এবং মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি কমায়। বাজার থেকে টাকা তুলে নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ৯০ ও ১৮০ দিন মেয়াদি বিল চালু করেছে। এই টাকা সমস্যায় থাকা ব্যাংকগুলোকে ধার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে।

গভর্নর বলেন, যারা ব্যাংক লুট করেছে, তাদের শেয়ার বিক্রি করে টাকা তোলা হবে। এসব শেয়ার যারা কিনবে, সেই নতুন মালিকেরা ব্যাংক পরিচালনা করবে। আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো তদারক করেনি, এখন করা হচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমানে ন্যাশনাল ব্যাংকের যে সমস্যা রয়েছে, তা মিটে যাবে। ব্যাংকের যে মূলধন ঘাটতি আছে, তা-ও পূরণ করা হবে। পাশাপাশি শেয়ার বিক্রি করে বা নতুন শেয়ার ছেড়ে মূলধন বাড়ানো হবে। সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের যে সমস্যা আছে, তা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এখন যে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, তাতে ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবে। টাকা ফেরত পেতে গ্রাহকদের আর কোনো ভোগান্তি হবে না। এই সমস্যা মিটে গেলে ব্যাংকের আমানতও বাড়তে শুরু করবে।

এস আলম নিয়ে প্রশ্ন

সমস্যায় পড়া এক্সিম ব্যাংক ছাড়া সব কটির নিয়ন্ত্রণ ছিল বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের কাছে। এই গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম। এ ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, তিনি (এস আলম) যে ধরনের কার্যক্রম চালিয়েছেন, সে ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। আইনগতভাবে এসব বিষয় দেখা হবে। অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে মামলা প্রস্তুত করা হবে। এর আগে এসব ঋণের বিপরীতে যে সম্পদ আছে, তার মান নির্ণয় করা হবে।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ‘এরপরই আমরা সামনে এগোব। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে খারাপ পরিস্থিতিতে নিয়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম দায়ী ব্যক্তি ছিলেন তিনি।’

সাইফুল আলম ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরপরই আহসান এইচ মনসুরকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করে অন্তর্বর্তী সরকার। তিনি দায়িত্ব নিয়েই নয়টি ব্যাংককে এস আলমমুক্ত করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যাংকগুলো থেকে কী পরিমাণ অর্থ নামে-বেনামে বের করে নেওয়া হয়েছিল, এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করার পর তা চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে।

সম্প্রতি ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আহসান মনসুর বলেন, শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা তাঁর শাসনামলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার কিছু সদস্যের সঙ্গে যোগসাজশ করে ব্যাংক খাত থেকে ২ লাখ কোটি সরিয়েছেন। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দপ্তরের সাবেক কিছু কর্মকর্তা শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক দখল করতে সহায়তা করেছেন। এসব ব্যাংক দখল করে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করা হয়েছে।